হিন্দু ধর্মের উল্লেখ বেদে কোথায় আছে?

বলা হয় যে, কোনো হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই। আবার বলা হয় যে এই হিন্দু শব্দটি বিদেশিদের দেওয়া নাম! এখন প্রশ্ন হলো, হিন্দু ধর্ম বলে আদৌ কি কোন ধর্মের অস্তিত্ব আছে? চলুন আজকের ব্লগে আমরা হিন্দু শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে এবং হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে এর উল্লেখ কোথায় রয়েছে সে বিষয়ে জানবো। 

$ads={1}

হিন্দু আমাদের একটি ভৌগলিক পরিচিতি ও সংস্কৃতির নাম।

হিন্দু মূলত কোনো ধর্মের নাম ছিল না। হিন্দু শব্দটি একটি ভৌগলিক পরিচিতি ও তার সংস্কৃতির নাম ছিল। যা সনাতন বৈদিক ধর্ম নামে পরিচিত ছিল, সেই ধর্ম ও সংস্কৃতি পরবর্তীতে হিন্দুধর্ম হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। কারণ এই হিন্দু সংস্কৃতির দেশে ধর্ম বলতে একক ব্যক্তির কর্ম, কর্তব্য এবং প্রকৃতিক বস্তুর অস্তিত্ব বা অবস্থাকে বোঝায়। 

তাই বেদ তথা বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্রে হিন্দু শব্দের উল্লেখ থাকলেও 'হিন্দু ধর্ম' এই শব্দটির কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। (যদি কেউ পেয়ে থাকেন, অবশ্যই জানাবেন। )

https://hinodcalture.blogspot.com/2023/10/brahmanism-and-christian-eucharist-of-holy-communion.html

সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দ বেদেই পাওয়া যায়।

শুক্ল যজুর্বেদের  একটি শ্লোক আছে যেখানে বলা হয়েছে, মধু পাতায়ে ঋতায়তে মধুক্ষরন্তে্সিন্ধ্ধ্বা”। সংস্কৃত বাঙ্ময় ব্যঞ্জন সন্ধির নিয়ম অনুসারে  'স' আর 'হ' সমার্থক বর্ণ হিসেবে বিবেচিত। ‘স’ এবং ‘র’ এর পরে ব্যঞ্জনবর্ণ থাকলে বিসর্গ ( ঃ)-এর ব্যবহার করা হয়। যেমন 'মানস্+পুত্র', 'মনস্ +পুত', ‘অন্তর্+ সত্তা’ এগুল যথাক্রমে মানঃপুত্র, মনঃপুত, অন্তঃসত্ত্বা এই ভাবেও লেখা হয়। 'হ'-এর উচ্চারণ ঘোষ কিন্তু বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ অঘোষ। বিসর্গ (ঃ) হলো অঘোষ 'হ্‌'-এর উচ্চারণে প্রাপ্ত ধ্বনি। বিসর্গের উচ্চারণ হ এর মতো হওয়ায় স এবং হ উভয় সমার্থক বর্ণ হিসেবে ধরা হয়। 

যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত আকারে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে তাদের তৎসম শব্দ বলে। তাই সংস্কৃত শব্দের ব্যাবহারের যে নিয়ম আছে। সেটা মেনেই চলতে হবে।

এবার দেখুন, বিসর্গের পরে ত/থ থাকলেহয়। যেমন— নিঃ + তেজ = নিস্তেজ, ইতঃ + তত = ইতস্তত ইত্যাদি। অতএব মধুক্ষরন্তে্সিন্ধ্ধ্বা কে মধুক্ষরন্তেহিন্ধ্ধ্বা বললেও ভূল হবে না। কারণ সিন্ধ ও হিন্দু সমার্থক। 

সিন্ধুই হিন্দু হয়েছে কিন্তু বিদেশীরা স কে হ করেছে। - এমনটা একেবারেই নয়। "সা" শব্দটিকে আরবীতে ص‍َاعًا বা صَ‍ۡع লেখা হয়। তাই তারা সিন্ধু বলতে গিয়ে হিন্দু বলতেন, তারা আমাদের হিন্দু বলতেন, এমনটা নয়। তাহলে ইসলাম শব্দটি ইহলাম হয়ে যেত।

 সেই যুক্তিতে হিব্রু এলোহিম (হিব্রু ভাষায়: אֱלֹהִים‎:) একটি হিব্রু শব্দ যার অর্থ "ঈশ্বরমণ্ডলী"। শব্দটি বহুবচন আকারে আছে একটি একক ঈশ্বরে বোঝায় না ।

অন্য ক্ষেত্রে এটি বহুবচনে দেবতাদের বোঝায়। হিব্রু লিপিতে এলোহিম। শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়। এল + ওহিম= এল শব্দের অর্থ সর্বশক্তিমান, ওহিম শব্দটি বহু বচন। অর্থাৎ এটি এক ইশ্বরের কথা বলা হচ্ছে না। ঈশ্বরের সমূহ বা গোষ্ঠীর কথা বলা হচ্ছে। বাইবেলের উৎপত্তি 1 : 1 প্রমাণ দেয় যে, তিনি ও সে, সেখানে ছিলেন। খ্রিষ্টান অনুসারে এটিই ইশ্বরের ত্রয়ী। 

অতএব, ইসলাম শব্দটি সেই ইসরাইলী এলোহিমের অপভ্রংশ। এর থেকে এটাই বলা বাহুল্য যে ইসলাম একটি মানব নির্মিত ও মানব কর্তৃক বিকৃত ধর্ম যেখানে ইশ্বর একাই সব কিছু তৈরী করেছেন। এই নিয়ে অন্য বিতর্ক আছে। 

আমাদের তাদের শব্দ  নিয়ে বিশ্লেষণে যাওয়ার দরকার নেই। ভারতের আসাম রাজ্যের মানুষেরাও ‘স’ কে ‘হ’ এর মতো উচ্চারণ করেন। উদাহণস্বরূপ অসমীয়া- কে তারা অহমীয়া উচ্চারণ করে। সেই ভাবেই তারা যদি বলে  "হকলের মঙ্গল হউক" বুঝতে হবে তারা বলছেন "সকলের মঙ্গল হোক"। 

হিন্দু শব্দের প্রমাণ পুরাণ শাস্ত্রে আছে

এছাডাও হিন্দু শব্দের প্রমাণ পুরাণ শাস্ত্রে আছে, যেমন বিষ্ণুপুরানে ভারতের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে:

"হিমালয়াত সমারভ্য যাবত ইন্দু সরোবরম। ত্বং দেব নির্মিতম্ দেশঃ হিন্দুস্থান  প্রচক্ষতে॥"

অর্থাৎ —হিমালয় বেষ্টিত সমুদ্র পর্যন্ত যে দেব নির্মিত দেশ রয়েছে, তাহা হিন্দুস্থান নামে পরিচিত।

"হিমালয়াত সমারভ্য যাবত ইন্দু সরোবরম হিন্দুস্থান ইতি ক্যাতান হি অন্তঃক্ষর যোগতাঃ"

  • হিমালয়ম: "হিমালয়ম" হিমালয়কে বোঝায়, উত্তর ভারতের পর্বতশ্রেণী।
  • সমরভ্যা: "সমরভ্যা" মানে "থেকে শুরু হওয়া"।
  • যাবত:  "যতদূর" বা "এর পরিমাণ পর্যন্ত।"
  • বিন্দুসরোবরম: "বিন্দুসরোবরম" ভারত মহাসাগরকে বোঝায়, যেখানে "বিন্দু" অর্থ "বিন্ধ পর্বত" এবং "সরোবরম" অর্থ "সমুদ্র বা জলাধার।" বিন্ধ পর্বতকে বেষ্টন করে যে সমূদ্র বা জলাধার আছে। 
  • হিন্দুস্থানাম: "হিন্দুস্থানাম" হল হিন্দুস্তানের শব্দ, যা ভারতীয় উপমহাদেশকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়।
  • ইতি: "ইতি" সংস্কৃতে একটি সাধারণ শব্দ যার অর্থ "এইভাবে" বা "এইভাবে।"
  • কিতান: "কিতান" এমন একটি শব্দ যা বোঝায় "বলা হয়" বা "হিসেবে কথিত " 
  • অন্তরাক্ষরযোগ: "অন্তরা" মানে "মধ্যে", "অক্ষরা" মানে "অক্ষর" বা "অক্ষর" এবং "যোগ" মানে "সংযুক্ত" বা "মিলিত।"
অর্থাৎ — “হিমালয় থেকে শুরু হয়ে যতদূর পর্যন্ত বিন্দু সরোবর (বর্তমানে ভারত মহাসাগর) কথিত হয়েছে, তার মধ্যের যে ভূ-ভাগ, তাহাই হিন্দুস্থান (বা হিন্দুদের স্থান)। যে দেশে হিন্দু সংস্কৃতির মানুষরা বসবাস করে তারাই হিন্দু।”

এ ছাড়াও অষ্টম শতকে লিখিত মেরু তন্ত্রে হিন্দুধর্ম শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা:— 

पश्चिमाम्नायमन्त्रास्तु प्रोक्ताः पारखभाषया। 
अष्टोत्तरशताशीतिर्येषां संसाधनात् कसौ।
पञ्च खानाः सप्तमीरा नव शाहा महाबलाः।
 हिन्दुधर्मप्रलोप्तारोजायन्वे चक्रवर्त्तिनः।
हीनञ्च दूषयत्येव हिन्दुरित्युच्यते प्रिये!। 
पूर्वाम्नाये नवशतं षड़शीतिः प्रकीर्त्तिताः।
फिरिङ्गभाषया मन्त्रास्तेषां संसाधनात् कलौ। 
अधिपामण्डलानाञ्च सग्रामेष्वपराजिताः। 
इरेजा नवषट्पञ्चलण्ड्रजाश्चापि भाविनः

পশ্চিমের আম্মায় (বেদ) পারখ ভাষায় মন্ত্রের প্রচলণ আছে। (সম্ভবত এটি পারস্য জরিস্ট্রিয়ান কথা বলা হচ্ছে। ) সেখানে পঞ্চখানা, সপ্তমীরা, নব শাহা এবং মহাবলী সম্পর্কে কোনো রাজা বা স্থানের নাম হতে পারে উল্লেখ করে বলা হয়েছে। এরা সম্ভবত প্রাচীন মুসলিম রাজা। এখানে মুসলিম উক্ত চক্রবর্তী রাজাদের জন্ম হিন্দু ধর্মের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। "হীনঞ্চ দূষযত্যেব হিন্দুরিত্যুচ্যতে ", যদি হিন্দু ধর্ম দুর্বল হয়, তবে সেটি দূষিত বা হীন হয়ে যাবে বলে জানান হয়েছে। 

পূর্বাম্নায়ে নবশতং ষড়শীতিঃ প্রকীর্তিতাঃ

  • এটি নির্দেশ করে যে পূর্বাম্নায়ে মোট ১৫৬টি (৯০ + ৬৬) বিশেষ মন্ত্র বা আচার রয়েছে, যা পূর্বাম্নায় তান্ত্রিক সাধনার উল্লেখ আছে। 

7. ফিরিঙ্গভাষয়া মন্ত্রাস্তেষাং সংস্কাধনাত্ কলৌ:

  • ফিরিঙ্গি (বিদেশি) ভাষায় এই মন্ত্রগুলির ব্যবহার কলিযুগে ঘটছে। এখানে বিদেশি প্রভাব বা ভাষার উল্লেখ রয়েছে।
সেই রাজা সম্ভবত চক্রবর্তী হয়ে হিন্দু ধর্মের ধ্বংস করে,  ফিরিঙ্গি ভাষায় এই মন্ত্রগুলি কলিযুগে সংগৃহীত হয়েছে এবং প্রাচীন সাম্রাজ্যের শাসকদের মধ্যে তাদের বিজয়ী রাজাদের সংগ্রহ রয়েছে।  इरेजा শব্দটি ইংরেজ বা ইরানের কথা বলে এবং নবশতপঞ্চ ল্যান্ড রাজও ভবিষ্যতের রাজা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

 রামকোষ --
"हिन्दुर्दुष्टो ना भवति नानार्यो न विदूषकः ।
 सद्धर्मपालको विद्वान् श्रौतधर्मपरायणः ॥" 
একজন হিন্দু দুষ্ট নয়, তিনি একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, বিদুষক (ফাজিল )নয়। তিনি স্বধর্ম পালক বিদ্বান, এবং শ্রুত ধর্মপরায়ণ। 

হেমন্তকবিকোষ-

"हिन्दुर्हि नारायणादिदेवताभक्तः  —একজন হিন্দুর নারায়ণ ও অন্যান্য দেবতার ভক্ত। 

অদ্ভুতরুপকোষ-

"हिन्दुर्हिन्दूश्च पुंसि द्वौ दुष्टानां च विघर्षणे |"

হিন্দু কাদের বলে?

মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজী হিন্দবা স্বরাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার বহু আগে অ্যালেক্সেডার হিন্দুকুট পর্বত দর্শনের ইচ্ছা প্রকশ করে ছিলেন। বর্তমান হিন্দুকুশ পর্বত পূর্বে হিন্দুকুট পর্বত নামে পরিচিত ছিলো। মেরু তন্ত্রের সেই উক্তি অনুসারে : 

...হীনং চ দূষ্যতেব হিন্দু ঋত্যচ্চতেপ্রিয়ে॥ (মেরু তন্ত্র)

—এই শ্লোক, যা বৈদিক সংস্কৃতে রচিত। এর অনুবাদ, অর্থ হল:এখানে সংস্কৃত শ্লোকের শব্দে-শব্দ ভাঙ্গন:


 - হীনম (hīnaṃ) = হীন ব্যাক্তি 

 - চ (ca) = এবং

 - দুষ্যতে (dūṣyate) = সমালোচনা করে, দূষিত বাক্য দ্বারা অপমান করে।

 - ইব (iva) = যেভাবে 

 - হিন্দু (হিন্দু) = হিন্দু

 - ঋতু (ṛtyu) = ধার্মিকতা

 - উচ্চতে (ucchate) = মহিমান্বিত করে

 - প্রিয় (প্রিয়ে) = হে প্রিয়


 "হে প্রিয়ে, হীন যেভাবে হিন্দুকে সমালোচনা করে ধার্মিক ব্যাক্তি (তাঁকে) মহিমান্বিত করে।"

এই শ্লোকটি হিন্দু দর্শনে গ্রহণযোগ্যতার গুরুত্ব তুলে ধরে। হিন্দু (তারাই যারা) হীনতা থেকে দূরে থাকেন ও দূরে রাখেন। 

এখন যারা বলেন, "হিন্দু ধর্মের উল্লেখ বেদে কোথায় পাওয়া যায় তাদের এই শ্লোক গুলো উদ্ধৃত করে দেখাবেন। 

ধর্ম কি? বৈদিক ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মমত গুলর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ধর্ম শব্দটি হিন্দুদের সংস্কৃত শব্দ। একে রিলিজিয়ন বা দ্বীন বা মাযহাব বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। কারণ, শব্দের সঠিক ব্যবহার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রিলিজিয়ন ও ধর্মের নামে যে যে সকল ভ্রান্তি আছে সেগুলো দূর করা দরকার। যেগুলো ধর্ম নয়, সেগুলোকে ধর্ম থেকে আলাদা করেই জানতে হবে।
full-width

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds