নাস্তিকদেরকে এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ যদি আপনার উত্তর হয়, "হ্যাঁ, ঈশ্বর পাপ করতে পারেন।" তাহলে ঈশ্বর নৈতিকভাবে অপরিপূর্ণ, যা তাঁর পূর্ণতা ও সর্বোত্তম গুণাবলি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
আবার যদি আপনার উত্তর হয়, "না, ঈশ্বর পাপ করতে পারেন না।" তাহলে আপনি স্বীকার করছেন ঈশ্বরের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে—তিনি সব কিছু করতে পারেন না।
এ ধরনের প্রশ্ন ঈশ্বরের ধারণাকে দর্শন ও যুক্তির আলোকে তাঁর সংজ্ঞার স্ববিরোধিতা বা সীমাবদ্ধতা বুঝতে ব্যবহার করা হয়।
যখন কোনো সানাতনীকে এই প্রশ্ন করা হয়। ঈশ্বর কি পাপ করতে পারেন? তার উত্তর হবে হ্যা, ঈশ্বর পাপকর্ম করতে পারেন। তাহলে কি সনাতনী ঈশ্বর নৈতিকভাবে অপরিপূর্ণ? নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো যুক্তি?
—এই উত্তর সনাতনদের দৃষ্টিতে আত্মবিরোধ নয়, বরং তা ঈশ্বরের সর্বব্যাপী ও অনন্ত স্বরূপের স্বীকৃতি। যে ঈশ্বর কেবল ভালো কিছুর মধ্যে আছেন, তিনি সনাতন ঈশ্বর নন—সনাতন ঈশ্বর আছেন পাপ-পুণ্য, আলো-অন্ধকার, সৃষ্টি-ধ্বংস—সবকিছুর মাঝেই। আগে জেনে নেওয়া যাক এই পাপ কি বস্তু।
পাপ কি?
দর্শনগতভাবে, “পাপ” হল একটি মানদণ্ড, যা মানুষের আচরণ-কে নিয়ন্ত্রণের জন্য গঠিত। হিন্দু ঈশ্বর সেই নিয়মের বাইরে যেমন আছেন, তিনি তার মধ্যেও আছেন। ঈশ্বর সজাতীয় এবং বিজাতীয় ভেদ শূন্য।
যদি আপনি ঈশ্বরকে “নৈতিক নিয়মের অন্তর্গত” ভাবেন, তবে ঈশ্বরের এই কাজকে লীলা বলা হয়। কিন্তু যদি ঈশ্বরকে “নৈতিক নিয়মের বাইরে” ভাবেন, তবে সেটা হবে ঈশ্বরের নির্লিপ্ততা — উভয় পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্থির।
বর্তমান ঈশ্বরের ধারণা গুলো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি কাঠামো। যা দিয়ে তারা সাদা ও কালো আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করতে চায়। কিন্তু আমরা বলি, এই জগতে সব কিছু সাদা কালো নয়। কিছু কিছু গ্রে, কিছু কিছু স্বচ্ছ। ভালো মন্দ উভয়ই এক সাথে থাকতে পারে। দিন এবং রাত্রিও এক সাথে থাকতে পারে যাকে আমরা বলি সন্ধ্যা বা ভোর।
আমাদের হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টি থেকে ভিন্ন কোনো অস্তিত্ব নয়। বরং ঈশ্বর ভিন্ন কোনো বস্তুই এই অস্তিত্বে নেই। তিনি তিনি পাপ বা পূণ্য দ্বারা বিবেচিত নয়। তিনি এমন পূর্ণতায় পূর্ণ যা থেকে কিছু তুলে নিলে সেই পূর্ণতা ক্ষয় হয় না বা পূর্ণতা বন্টন হয়ে যায় না। অর্থাৎ, তিনি সব কিছুর মূর্তিমান রূপ।
ঈশা উপনিষদের এই বিখ্যাত মন্ত্রটির প্রতিধ্বনি:
অর্থ:
এই চিন্তা মতে ঈশ্বর নির্দিষ্ট কর্মকারী নয়, তিনি স্বরূপত কর্ম। তিনি সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা চৈতন্য — কর্ম, ফল, সময়, স্থান — সবকিছুই তাঁর প্রকাশমাত্র।
— এই দর্শন হিন্দু ধর্ম ঈশ্বরকে নির্লিপ্ত বলে। পক্ষান্তরে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম গুলো ঈশ্বরকে এমন এক চূড়ান্ত নৈতিক সত্তা হিসেবে দেখে, যিনি নিজে একেবারে। পাপ মুক্ত, উজ্জ্বল, শ্রেষ্ঠ এবং সর্বোৎকৃষ্ট হিসেবে উপস্থিত করে।
তাই, ঈশ্বর কি পাপ করতে পারে, এই প্রশ্নের জবাবে তাঁদের ঈশ্বর জ্ঞান স্ববিরোধী হয়ে যায়।
ঈশ্বরের গুণাবলী :
ঈশ্বর কোনো ডিক্টেটর নন, কারণ তিনি মানুষের মুক্ত ইচ্ছার বার বার মর্যাদা দেন — মানুষকে নিজের প্রকৃতি অনুসারে পথ বেছে নিতে স্বাধীনতা দেন।
তিনি, তারই সৃষ্টিতে, উৎপন্ন জীবের অহংকার দমন, মোহভঙ্গ, প্রকৃত সত্য উপলব্ধির জন্য এবং ধর্ম (ন্যায় ও স্থিরতা) পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অবতীর্ণ হন।
তিনি ইচ্ছা করলেই কর্ম করতে পারেন। তবে কর্মের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন না।
ঈশ্বরের নির্লিপ্ততা
সব কিছুর মাঝে তিনি থেকেও তিনি নির্লিপ্ত থাকেন। “তাঁর নির্লিপ্ততা” প্রসঙ্গে ভগবান বলেছেন:
(১)
न मां कर्माणि लिम्पन्ति, न मे कर्मफले स्पृहा।इति मां योऽभिजानाति कर्मभिर्न स बध्यते॥গীতা, অধ্যায় ৪, শ্লোক ১৪
বাংলা অর্থ:
“কোনো কর্মই আমাকে স্পর্শ করে না, এবং কর্মফলে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষাও নেই। যে ব্যক্তি এইরূপে আমাকে জানে, সে কখনো কর্মে আবদ্ধ হয় না।”
(২)
न मे पार्थास्ति कर्तव्यं त्रिषु लोकेषु किञ्चन।नानवाप्तमवाप्तव्यं वर्त एव च कर्मणि॥গীতা, অধ্যায় ৩, শ্লোক ২২
বাংলা অর্থ:
“হে পার্থ, আমার জন্য তিন জগতে কিছুই করণীয় নেই। প্রাপ্ত করিবার কিছুই আমার নেই, তবুও আমি কর্মে নিযুক্ত আছি।”
এখানেই ঈশ্বরের “সর্বশক্তিমান্যতা” প্রকট হয় — শুধু কর্মে নয়, নির্বাচনের স্বাধীনতাতেও হিন্দু সনাতন ঈশ্বরের তুলনা হয় না।
0 Comments: