সুফিবাদ ইসলামের সুন্দর স্বরুপ। Sufism is a beautiful form of Islam.
এর আগে আমি ইসলাম সম্পর্কে সমালোচনা করেছি। ইসলামের বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবির খন্ডন করেছি। আজ আপনাদের বলতে চাই, এই ইসলামের সুন্দর একটা দিকও আছে। যাহাকে ধর্ম বলা যায়। তবুও ইসলাম একটি সৃষ্ট ধর্মই থাকবে। কারণ, ধর্ম শব্দটি ভারতীয় বৈদিক ধর্মের। ইসলাম একটি মজহ্ব বা দ্বীন। আবার, এই দ্বীন-এ-ইসলামের সুন্দর মতবাদটা ফুটে উঠেছে এই ভারতের মাটিতে। সেটি হলো সুফিবাদ।
সুফি শব্দের উৎপত্তি ফারসি শব্দ সুফ থেকে, যার অর্থ জ্ঞান। ফিলোসফির সফি সুফ থেকেই এসেছে। তুর্কি ও ফারসি দার্শনিক যখন ভারতের ধর্ম তত্ত্ব নিয়ে গবেষনা শুরু করে। ঈশ্বরের কৃপায় তারা ইসলামী শরিয়ত ও ______ কে মিলিয়ে একটি আরবি ভাবধারা থেকে উন্নত ভাবধারা তৈরী করেন।
এই সুফিবাদ ভারতের ভক্তি আন্দোলনের সময় জুড়ে গিয়েছিলো। নানক, চৈতন্য মহাপ্রভুর সেই ভক্তি ধারায় বহু মুসলিম, ফকির, ওউলামা, পীর, মুরিদ হিন্দু ধর্মে একাকার হয়ে গিয়েছিলো।
এই সময় হিন্দু ভাববাদীরা এই সুফীদের থেকেও কিছু রস বের করে আরেকটি সম্প্রদায় তৈরী করেন। এরা হলো বাউল, ফকির ও পাগল (উন্মাদ নয়)। এরা গান গেয়ে দেহ তত্ত্বকে সমাজে প্রচার করে। হিন্দুদের অনেকেই না বুঝে এই বাউল, ফকিরদের ভন্ডামি বলে বদনাম করে।
সুফি সঙ্গীত আপনারা শুনে থাকলে, আপনারা নুসরত ফতঃ আলি খানের সেই বিখ্যাত সুফি সঙ্গীত নিশ্চই শুনে থাকবেন,
স্বাস কি মালা মে সিমরু ম্যা, পি’ কা নাম।
সেই গানের একটি লাইন আছে— “জবসে রাধা শাম কে, নয়ন হুয়ে হ্যা চার। শাম বঽনি হ্যা রাধিকা, রাধা বঽনগয়ী শাম॥"
এই সব কারণে, উগ্র ইসলাম পন্থীরা সুফিবাদ কে বেদাতী, ইসলাম বহির্ভূত মনে করেন।
আজকের আলোচনা এই সুফিবাদের বিশাল রত্ন ভান্ডার নিয়ে।
ইসলামে খোদা বড় নাকি খিদমদ্গার?
খাদেম হলেন আল্লাহ (রব), তিনি হলেন সকল মুমিন মুসলিমদের আত্মিক স্বামী। যদিও কোরআন শরীফ বলছে আল্লাহর কোনো স্ত্রী পুত্র নেই।
ইসলামের মূল ধারণা অনুসারে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। কুরআনের সূরা ইখলাস (১১২:১-৪) স্পষ্টভাবে বলে:
"বলো, তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। তার কোনো সমতুল্য নেই।"
কোরআনের আল্লাহকে সর্বোচ্চ, অতুলনীয় এবং সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে বলা হয়েছে। সুতরাং, ইসলামে আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ, এবং তাঁর সঙ্গে কোনো "খিদমদ্গার" (সেবক বা সহযোগী) বা অন্য কোনো সত্তার তুলনা করা যায় না।
"আল্লাহু আকবর" এর অর্থ "আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ" বা "আল্লাহ মহান", যা তাঁর অতুলনীয় মহত্ত্বের কথা বোঝায়। এখানে "বড়" বা "ছোট" এর ধারণাটি আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়, কারণ তিনি সৃষ্টির সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। "খিদমদ্গার" শব্দটি যদি আল্লাহর সেবক বা মানুষের সেবার প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়, তবে ইসলামে মানুষকে আল্লাহর "ইবাদতকারী" বা বান্দা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহর সঙ্গে তাঁর বান্দার সম্পর্ক শুধুমাত্র স্রষ্টা ও সৃষ্টির, যেখানে আল্লাহ সর্বোচ্চ।
ইসলাম একটি সৃষ্ট ধর্ম:
"ধর্ম" শব্দটি আরবি "দ্বীন", ফারসি "মাজহাব", বা ইংরেজি "রিলিজিয়ন" এর সঙ্গে পুরোপুরি সমার্থক নয়। ভারতীয় দর্শনে "ধর্ম" শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ "ধৃ" (ধরে রাখা) থেকে, যার অর্থ জীবনের এমন একটি পথ বা নীতি যা বিশ্বের সনাতন সত্য ও নৈতিকতাকে ধরে রাখে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে (যেমন ভগবদ্গীতা, মনুস্মৃতি, বা উপনিষদ) ধর্মকে প্রায়ই ব্যক্তি ও সমাজের জন্য নৈতিক, আধ্যাত্মিক, এবং সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। এটি কেবল আচার-অনুষ্ঠান বা বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের একটি সামগ্রিক পথ।
অন্যদিকে, ইসলামে "দ্বীন" শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যা আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য, জীবনব্যবস্থা, এবং ইবাদতের পথকে বোঝায়। কুরআনে বলা হয়েছে:
"নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হলো ইসলাম" (সূরা আল-ইমরান, ৩:১৯)।
"মাজহাব" সাধারণত ইসলামের বিভিন্ন সম্প্রদায় বা ফিকহের বিদ্যালয় (যেমন হানাফি, শাফিঈ) বোঝায়। "রিলিজিয়ন" পশ্চিমা ধারণায় প্রায়শই সংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা বিশ্বাসের সিস্টেমকে বোঝায়। কিন্তু ভারতীয় "ধর্ম" এর ধারণা এর চেয়ে অনেক ব্যাপক এবং জীবনের সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।
২. আল্লাহকে "স্বামী" হিসেবে ভাবা এবং সুফিবাদের দৃষ্টিভঙ্গি
সুফিবাদে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে প্রায়ই ভালোবাসা, নৈকট্য এবং আধ্যাত্মিক ঘনিষ্ঠতার দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়। সুফি কবি ও দার্শনিকরা (যেমন রুমি, হাফিজ, রাবিয়া বসরি) প্রায়ই আল্লাহকে "প্রিয়" বা "মহব্বতের আল্লাহ" হিসেবে উল্লেখ করেন। এই "স্বামী-স্ত্রী" সম্পর্কের ধারণাটি একটি রূপক (metaphor), যা সুফিবাদে ব্যবহৃত হয় ভক্ত ও আল্লাহর মধ্যে গভীর প্রেম ও নৈকট্য প্রকাশ করতে। এটি শারীরিক বা বৈষয়িক সম্পর্ক নয়, বরং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক।
কুরআনে আল্লাহর স্ত্রী বা পুত্রের ধারণাকে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করা হলেও (সূরা ইখলাস), সুফিরা তাঁকে "আপন" হিসেবে দেখার চেষ্টা করেন। এটি আল্লাহর রহমত ও ভালোবাসার প্রতি তাদের গভীর আকাঙ্ক্ষা।
সুফিবাদে এই প্রেমকে "ইশক-ই-হাকিকি" (প্রকৃত প্রেম) বলে, যেখানে ভক্ত আল্লাহর সঙ্গে একীভূত হতে চায়। আল্লাহ এই প্রেমকে ইনকার করেন না; বরং কুরআনে বলা হয়েছে, "আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাময়" (সূরা বাকারা, ২:২০৭)।
উপসংহার
সুফিবাদ ইসলামের একটি সুন্দর ও আধ্যাত্মিক দিক, যা ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে মিলে একটি অনন্য সংমিশ্রিত সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এটি হিন্দু ও মুসলিম আধ্যাত্মিকতার মধ্যে একটি সেতু তৈরি করেছে, যেখানে বাউল, ফকির, এবং সুফি সঙ্গীতের মতো ঐতিহ্য ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও একত্বের বাণী ছড়িয়েছে।
নুসরত ফতেহ আলি খানের কাওয়ালি এই সংমিশ্রণের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তবে, আপনার ইসলামযে একটি "সৃষ্ট ধর্ম" বলা অনুচিত নয়। কারণ, ধর্ম শব্দটি মাজহাব বা দ্বীন এর মতো নয়। ভারতেই ইসলামকে ধর্ম নাম দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি মনে হতে পারে। তবে এটাই সত্য।
ইসলামের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে এটি আল্লাহর দেওয়া চূড়ান্ত ধর্ম। সুফিবাদ, যদিও ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ফুটে উঠেছে, তবুও এটি ইসলামের মূল শিক্ষার (কুরআন ও হাদিস) উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
অবশেষে বলতে চাই, এটা যথেষ্ট নয়। অনেক তত্ত্ব ও রহস্য আছে। যা এই লেখা সম্ভব হলো না।
0 Comments: