Varna Shankar o jatir sankshipta itihaas | বর্ণ সংকর ও জাতির ইতিহাস
শ্রীমদ্ভগবত গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— “চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।”
অর্থাৎ গুণ ও কর্ম অনুসারে বর্ণ তৈরি হয়। কিন্তু বর্ণ সংকর তৈরি হয় দুটি আলাদা আলাদা বর্ণের মিলনে। জাতি বিচার দুই ভাবে হয়, প্রথমত জন্মগত জাতি এবং দ্বিতীয়ত কর্মগত জাতি। জন্মগত জাতির বিচার পূর্বে হতো। কারণ, তখন রাজার ছেলেই রাজা হতো। কর্মগত জাতির বিচার তখন জোরালো ছিলো না। বর্তমানে কর্মগত জাতির বিচার করা হয়। কারণ আজ মন্ত্রী আছে রাজা নেই। রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে।
আজকে এই প্রতিবেদনে। আমরা আলোচনা করবো গুণ ও কর্মের প্রকার নিয়ে, বর্ণ উৎপত্তি ও তার বিকাশ নিয়ে, প্রতিটি বর্ণের ধর্ম ও অধিকার নিয়ে।
গুণ কর্মে কিভাবে বর্ণ উৎপন্ন হয়?
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন গুণ ও কর্ম বিভাগে বর্ণ উৎপন্ন হয়েছে। বেদে বলা হয়েছে বিরাট পুরুষের দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে চার বর্ণের উৎপত্তি। মনুও প্রায় একই কথা বলছেন।প্রায় একই বলছি কারণ , বেদ বলছে বৈশ্য বর্ণের উৎপত্তি উদর থেকে, স্মৃতি বলছে বৈশ্য বর্ণের উৎপত্তি উরু থেকে। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তে বলা হয়েছে —
ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীত্ বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ।ঊরু তদস্য যদ্ বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত॥
এতগুলো ব্যাখ্যায় কোনটি সঠিক?
উত্তর হলো, সব গুলোই সঠিক। মনোস্মৃতি বিরাট পুরুষের দেহে এখানে একটি উপমা। আর গুণকর্ম হলো জন্মগত গুণ ও শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্মের অধিকার। এই বিরাট পুরুষ হলো প্রকৃতিস্থ অবর ব্রহ্ম। যার উপাসনা বিষ্ণু রূপে করা হয়। সেই বিষ্ণুর দেহই এই সমাজ। সমাজের সকলেই সেই বিষ্ণু রূপে স্থির।
গুণের প্রকারভেদ
সেই গুণ ও কর্মের নীতি অনুসারে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এবং শূদ্র এই চার বর্ণের উৎপত্তি। পরমেশ্বর প্রকৃতিস্থ মায়াকে অবলম্বন করে জগত সৃষ্টি করেছেন। শাস্ত্রে এই গুণকে তিন প্রকার বলা হয়েছে। যথা –সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক।
কর্মের প্রকারভেদ
এছাড়াও প্রায়শ্চিত্য কর্ম নামে পঞ্চম প্রকার কর্ম আছে যাহার দ্বারা পাপ নাশ হয়। একে তপস্যা বলা হয়।
কর্মের প্রভাব
কায়া, মন ও বাক্য এই তিন দ্বারা কর্মের স্থান। এদের দ্বারা যে কোনো কর্ম করলে দুটি জিনিস হয়। প্রথমত সেই কর্মের দ্বারা সংস্কার উৎপন্ন হয় এবং সংস্কার থেকে কৃত কর্মের স্মৃতি তৈরী হয়। অর্থাৎ পুনরায় ওই কর্মের আসক্তি বা ওই কর্ম পুনরায় করার সাহস তৈরি হয়।
কর্ম ফলের বিভাগ অনুসারে কর্মকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই প্রকার যথা — ১) নিত্যকর্ম, ২) নৈমিত্তিক কর্ম, ৩) কাম্যকর্ম, ৪) নিষিদ্ধকর্ম, এবং ৫) প্রায়শ্চিত্য কর্ম
নিত্যকর্ম কে বলা হয় পঞ্চ যজ্ঞ। পঞ্চ যজ্ঞ না করলে পাপ ক্ষয় হয় না। নৈমিত্তিক কর্ম হলো বিশেষ বিশেষ সময়ে পূজা অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
আমাদের জানা অজানায় আমরা যত প্রকার কর্ম করেই থাকি তার ফলে আমাদের কর্মফল নির্ধারিত হয়। আমরা যে কর্ম করছি সেটিকে ক্রিয়মান কর্ম বলা হয়। যেমন, পশু সেবা, জন সেবা, বিদ্যা অর্জন, ইত্যাদি। এদের কিছু কিছু ফল আমরা এই জন্মেই পেয়ে যায়। আবার কিছু কিছু কর্মের ফল পাই না। কিন্তু ঈশ্বরের খাতায় সেই কর্ম গুলো সঞ্চিত থাকে।
তাই, কর্মে অধিকার আছে, কর্মের ফল দেওয়ার জন্য ঈশ্বর সঠিক স্থান, কাল নির্ধারণ করে রেখেছেন। জন্ম জন্মান্তর ধরে সেই কর্ম গুলো সঞ্চিত হতে থাকে। জন্ম জন্মান্তরে যে কর্ম গুলো সঞ্চিত হয় সেগুলোই — সঞ্চিত কর্ম বলা হয়। এই সঞ্চিত কর্মের কারণে আমরা অনেক সময় অল্প চেষ্টায় বড় সাফল্য বা অনেক চেষ্টায় নিষ্ফল হয়ে যাই বা হঠাৎ চুরি ছিনতাই খুন হয়ে যাওয়া।
আবার, যে কর্মের দ্বারা এই শরীর প্রাপ্ত হয়, তাঁকে প্রারব্ধ কর্ম বলা হয়। যেমন, কেউ জন্ম থেকে বিকলাঙ্গ, কেউ জন্ম থেকেই রাজা, জ্ঞানী, ধনী ও দরিদ্র বা কেউ কেউ নিন্দিত পরিবারে জন্ম নেয়। এছাড়াও কুকুর, বিড়াল বা বিভিন্ন পশুর শরীর প্রাপ্ত হওয়া বা আকস্মিক রোগ বা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ইত্যাদি কর্মের দ্বারাই নির্ধারিত।
জাতি বিভেদ
পূর্ব জন্মের সঞ্চিত কর্ম এবং প্রারব্ধ কর্ম থেকেই জন্ম বা জাত নির্ধারিত হয়। যার নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। এগুলো দৈব বা ভাগ্যের ব্যাপার।
কেউ যদি ক্ষত্রিয় হতে চায়, কিন্তু শূদ্র পরিবারে জন্ম নেয়। সে সেটা হতে পারবে না। কারণ, চাইলেও সে নিজের জন্মদাত্রী মা বাবা পরিবর্তন করতে পারবেন না। কিন্তু সে কর্মের দ্বারা নিজের দক্ষতা অর্জন করে রাজা হতে পারে, তবু তাঁর সঙ্গে শূদ্র পরিচয় তো জুড়েই থাকবে।
রবিদাস, কবির শূদ্র জাতিতে জন্ম নিয়েও নিজের কর্মের দ্বারা রাজা ও ব্রাহ্মণ সমতুল্য সম্মান পেয়েছেন। আবার ব্রাহ্মণ জাতিতে জন্ম নিয়েও রাবণ নিজের অপ গুণে রাক্ষস বলে নিন্দিত হয়েছে।
আমাদের ভারতীয় শাস্ত্র ও ধর্মীয় পুস্তক অনুসারে পূর্বে কোনো জাতিভেদ ছিলো না। সকলেই দেবতা বা ব্রহ্ম-ঋষি ছিলো। ব্রহ্মার পুত্ররা ছিলেন ঋষি, এবং তাদের সন্তানরাও ছিলেন ঋষি। এভাবে ব্রাহ্মণই একমাত্র বর্ণ ছিলো।
পুরাণ অনুসারে প্রথম প্রজাপতি ছিলেন রাজা দক্ষ, এই দক্ষরাজের ঘরে জন্ম হয় মাতা সতী সহ বিভিন্ন দেবীর। শিবের সঙ্গে বিবাহ হয় মাতা সতীর এবং ঋষি কাশ্যপ দক্ষের পুত্রীদের বিবাহ করেন এবং তাঁদের গর্ভ থেকে জন্ম হয় মানব, অসুর, যক্ষ, রাক্ষস, সর্প ও নাগ, পক্ষী ইত্যাদি জীব বা প্রজার। পরবর্তীতে দক্ষের কন্যাদের সঙ্গে ভিন্ন দেবতার বিবাহ হয়। এভাবেই প্রজার সৃষ্টি হয়।
সেই প্রজাপতির প্রজা ছিলেন কারা? এর উত্তর হলো সমগ্র জীব জগৎ। মনুস্মৃতির আগে দক্ষ সংহিতাই ছিলো ধর্ম শাস্ত্র এবং সমাজের সংবিধান। দক্ষরাজের নিজ পুত্র সহ সকল ঋষি এবং ঋষিপুত্রদের দক্ষ সংহিতা অনুসারে চলতো।
অতএব, আমরা দেখি গুনের প্রভাবে ও কর্মের দ্বারা বিভিন্ন জাতি প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ প্রথম ছিলো। তাই তাঁর অধিকার আগে। আগে জন্ম বলেই ব্রাহ্মণকে অগ্রজ বলা হয়।
শুধু মানুষ কেন মৌমাছি, পিঁপড়া বাঘ, নেকড়ে প্রভৃতি জীব জন্তুদের মধ্যেও অধিকার ভেদ আছে। রানী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি, শ্রমিক মৌমাছির বিষয়ে বিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই পড়েছি। এটা প্রকৃতি প্রদত্ত গুণ ধর্ম।
আজকাল, যারা সকলের সমান অধিকার নিয়ে কথা বলে। খোঁজ নিয়ে দেখবে পিতার বয়সী নিজের বাড়ির দারোয়ান, ড্রাইভার বা সহকারী কর্মচারীকে নিজের পিতার মতো সমান বা অধিকার দেয় না। অর্থাৎ, অফিসের বস আর সুইপার সমান হয় না। শিক্ষিত হয়েও এরা বয়স বিচার না। একে বলা হয় সমাজের Code Of Condact .
পুরাণ অনুসারে জাতির ইতিহাস
পুরাণ গ্রন্থ গুলো বেদের তত্ত্বকেই গল্প আকারে ব্যাখ্যা করে। কালিকা পুরাণ অনুসারে সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা কামদেবকে সৃষ্টি করলো। কামদেব নিজের শক্তি পরীক্ষা করতে প্রথমে তাঁর উৎপত্তি কারক ব্রহ্মাকেই কামবান নিক্ষেপ করেন। তখন সম্মুখে দেবী সন্ধ্যা সহ ব্রহ্মার পুত্র অর্থাৎ ঋষিরা ছিলেন। প্রত্যেকেই দেবী সন্ধ্যার প্রতি কামুক দৃষ্টি দিয়ে আত্ম সম্বরণ করে কাঁপতে লাগলো। তখন প্রতিটি ঋষির দেহ থেকে ঘাম (স্বেদ) ঝরতে শুরু করলো।
তারপর সেই ঘাম থেকে পিতৃগন উৎপন্ন হলেন।পিতৃগন সমাপা, সুকালিন, হবির্ভুজ, বহির্ষদ ইত্যাদি। ব্রহ্মার দেহ থেকে ঘাম ঝরাতে শুরু করলো, সেখান থেকে ৪৯ টি সাত্ত্বিক গুণ সৃষ্টি হলো। এবং তার পুত্রদের দেহ থেকে বিভিন্ন প্রকার পিতৃগন জন্ম হলো।
সমাপগণ ক্রুতুর পুত্র; সুকালিনগণ বসিষ্ঠের পুত্র; আজ্যপগণ পুলস্ত্যের পুত্র; এবং হবির্ভুজগণ অঙ্গিরার পুত্র।”
— কালিকা পুরাণ, দ্বিতীয় অধ্যায়
যারা জ্ঞান, বুদ্ধি ও সাধনা দ্বারা নিজেকে ব্রহ্ম কর্মে নিযুক্ত করেছেন, সেই প্রজাগনদের ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। কব নামক পিতৃ করে।
যারা বল পরাক্রম দ্বারা নিজের দক্ষতা অর্জন করেছেন, সেই প্রজাগন ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত। এরা হবিরভজ নামক পিতৃ করে।
যারা ধণ, ঐশ্বর্য, উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষতা অর্জন করে প্রজাগন বৈশ্য নামে পরিচিত। এদের পিতৃগন আজপা।
এবং উক্ত তিন বর্ণের অর্থের বিনিময়ে সেবায় নিযুক্ত প্রজাগন, শূদ্র বলে পরিচিত। এদের পিতৃগণ সুকালীন।
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এবং শূদ্র এই চার হল প্রজাপতির প্রজা। এই ঋষিদের নামে আমাদের গোত্র — সান্ডিল্য, কশ্যপ, ভরদ্বাজ প্রভৃতি।
কর্মসংস্থান ও আর্থিকসংস্থান
ঋষিদের প্রচেষ্টায় এই চার বর্ণকে নিজ নিজ কর্মে নিযুক্ত করা হলো এবং বলা হলো, এরা জন্ম অনুসারে পৈতৃক কর্মকেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কারণ, এটি ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষেদের একটি সর্ব সম্মত ও সর্ব স্বীকৃত সামাজিক কাঠামো। যেখানে সবার জন্য কর্মসংস্থান ও আর্থিকসংস্থান রক্ষিত ছিলো। আজ এর তেমন গুরুত্ব দেখা যায় না। তখন এগুলো বেশ প্রচলন ছিলো।
কারণ, রাজতান্ত্রিক সমাজে সবাই নিজ পরিবার ও সামাজিক পরিবেশ থেকেই প্রথম শিক্ষা অর্জন করত। শিল্প, কলা, কৌশল ও পারদর্শিতা জন্মগত ভাবে বংশ পরম্পরায় ও সামাজিক পরিবেশ থেকেই আসে। সেটাকেই প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে চলতে থাকলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি তৈরী হবে। নিজের পৈত্রিক কর্ম ও পরিচয় নিয়ে গর্ব করার বদলে হীন মান্যতা কিভাবে হলো?
যখন কেউ স্রোতের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু চেষ্টা করে। তাঁকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়, তার সফলতার সুযোগ কমে যায়।
আজকের যুগে দাঁড়িয়ে। এই প্রতিযোগিতার বাজারে নতুন বিষয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাটুকারিতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, চাকরী দুর্নীতির কারণে কর্মসংস্থান ও আর্থিকসংস্থান কপালে জুটে না।
প্রতিযোগিতা তো আগে রাজার সন্তানদের মধ্যেও হত। পন্ডিতের পাণ্ডিত্য দেখাতেও প্রতিযোগিতা হত। চাটুকারিতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা সেই সময়েও ছিলো। কিন্তু সেই সময় প্রতিযোগিতায় বেইমানি করে কেউ জিততে পারতো না। কারণ, কর্মসংস্থান ও অর্থসংস্থান সুরক্ষিত ছিলো। বেকারত্ব ছিলো না
বর্তমান যুগে পেশা নির্বাচনে কি করণীয়?
জন্ম দিয়ে কোনো পেশাগত দক্ষতা আসে না। তাই আজকের সমাজে গুণ, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতেই পেশা নির্বাচন করা উচিত। কেউ চাইলে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিভিন্ন কোর্স করে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আজ সেই আগেকার মতো কাজ নেই। এখন কাজের ক্ষেত্র, পরিস্থিতি, পদ্ধতি ও নিয়ম বদলে গেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যন্ত্র ও প্রযুক্তি দ্বারাই সব হচ্ছে।
যদি পৈতৃক পেশার সাথে আপনার আগ্রহ মিলে, তাহলে অবশ্যই সেটি বেছে নেওয়া ভালো। কিন্তু শুধু “আমার পরিবার এটাই করত” — এই যুক্তিতে পেশা বেছে নিলে হতাশার সম্ভাবনা বেশি।
পেশা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও বাস্তব চিন্তা করুন। শুধু “মনের পছন্দ” দিয়ে নয়, পেশা বেছে নিতে হবে বাজারের চাহিদা, আয়ের সুযোগ, ভবিষ্যতের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে।
পৈতৃক পেশা রাখাই যায়, যদি সেটির সঙ্গে নিজের আগ্রহ মেলে এবং সেটিকে সময়ের সাথে আধুনিক করা যায়। আজকের যুগে নমনীয়তা বা flexibility-ই সবচেয়ে বড় মূলমন্ত্র।
ব্রাহ্মণ্যবাদ, সমাজবাদ ও পুঁজিবাদ
পুঁজিবাদ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের উপকরণ ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকে। ব্যবসা, শিল্প ও বাণিজ্য লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এখানে বাজারের চাহিদা-জোগান ও প্রতিযোগিতা মূল নিয়ামক। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, উদ্ভাবন এবং স্বাধীনতা পুঁজিবাদের মূল ভিত্তি।
সমাজবাদ এমন একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের উপকরণ (যেমন জমি, কারখানা, সম্পদ) ব্যক্তিগতভাবে নয়, সমষ্টিগতভাবে বা রাষ্ট্রের মাধ্যমে মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মূল লক্ষ্য সম্পদের সমান বণ্টন, সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। সমাজবাদে লাভ বা ব্যক্তিগত মুনাফার চেয়ে সামাজিক কল্যাণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজ গঠনে বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ কে বলা হলো ঈশ্বরের মুখ, ক্ষত্রিয় হাত, বৈশ্য উদার এবং শূদ্ররা হলেন ঈশ্বরের চরণ। ব্রাহ্মণ নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি দ্বারা সমাজকে রক্ষা করে। ক্ষত্রিয় বল, পরাক্রম, ও বলিদান দ্বারা সমাজকে রক্ষা করবে। বৈশ্য ধণ, খাদ্য, বস্ত্র, পশু উৎপাদন দ্বারা সমাজকে শক্তিশালী করবে এবং শূদ্র সেই জ্ঞান, সুরক্ষা এবং অর্থের বিনিময়ে সমাজকে নিজ কর্ম দক্ষতা দ্বারা অগ্রগতি প্রদান বা উন্নতি সাধন করবে। এভাবে শূদ্রকে অনেক স্বাধীনতা কিন্তু কম অধিকার দেওয়া হয়েছে বলা হয়েছে। এরই নাম দেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ।
জাত বিচার ভেদাভেদ।
শাস্ত্রে পরিকল্পিত ভাবে জাতিতে জাতিতে ভেদ করা হয়েছে কিন্তু কাউকে জাতীয় বিচার করে উচু বলে সম্মান বা নিচু হেয় করা হয়নি।
ঋষিদের প্রচেষ্টায় এই ভেদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সামাজিক সম্পর্ক বর্ননা করা হয়েছে। যাতে কেউই করো ঊর্ধ্বে যেতে না পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে এক বর্ণ আরেক বর্ণের অতিক্রম করে স্বেচ্ছাচার শুরু হলে এই ভেদাভেদ উঁচুনিচু জাতের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই মিশ্র বর্ণ অর্থাৎ গুণ ও কর্মের বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কাজের ক্ষেত্র নিপুণতা ও কাজের মধ্যেও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে —এটাই জাতি সংকর ।
যেমন, বিদুরের পিতা হলেন মহর্ষি ব্যাস এবং মাতা হলেন অম্বিকা ও অম্বালিকার দাসী (অন্য এক দাসী নারী)। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ও শূদ্র জাতির মিলনে উৎপন্ন সন্তানকে কি উত্তরাধিকার বঞ্চিত করা হয়নি। বিদুর রাজা হওয়া উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। তবুও তিনি রাজসভায় পরামর্শ দাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আবেদন করেন। তিনিরাজকুমার পান্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গুরু গৃহে শিক্ষা অর্জনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হননি। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পিতার দক্ষতা জ্ঞান ও শূদ্র মাতার সেবা দক্ষতাকে বিচার করা হয়েছে।
এভাবেই, ক্ষত্রিয় পিতা ও ব্রাহ্মণ মাতার বিবাহে উৎপন্ন নতুন সংকর সন্তানকে বলা হতো সূত। ক্ষত্রিয় পিতার বল ও ব্রাহ্মণ মাতার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সুত জাতির কাজ ছিলো অশ্ব পালন, রথ চলন ইত্যাদি। কর্নকে ভুল করে সূত পুত্র মনে করে তাকেও কি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে? দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গ নামক রাজ্য দান করেছিল। আবার সেই এই কর্ন ছোটবেলা থেকেই দান কর্ম করতেন। প্রচলিত নিম্ন জাতির হাতে ব্রাহ্মণ গ্রহন করে না –এই অপবাদও মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ, জন্ম অনুসারে গুণ এবং গুণ অনুসারে কর্মের বিভাগ ছিলো।
অস্পৃশ্যতা
অস্পৃশ্যতা অপবিত্রতা বা শুদ্ধতা বিষয়ক। অশৌচতা একজন ব্রাহ্মণ, চন্ডাল, চামার, মুচি নির্বিশেষে পালিত হয়। নবজাতকের জন্ম, মল মূত্র ত্যাগ, শশান গমন ইত্যাদি ক্ষেত্রে শৌচ নিয়ম পালন করা হয়। আশৌচ নিয়ম গুলো হলো, মুখ বা মাথা, হাত ও পা প্রক্ষালন, স্নান এবং আচমন করা। অশৌচ অবস্থায় সূর্য, চন্দ্র বা নক্ষত্র দেখতে নাই। পূজা বা বৈদিক কর্ম করতে নেই। এর সঙ্গে জাত পাত বা বর্ণের কোনো ভেদ নেই।
প্রতিটি সম্প্রদায়ের কিছু কিছু লোক নিজেদের মধ্যে মাতব্বরি ও ঈর্ষা বৃত্তি করে সমাজকে দূষিত করে। মুঘল ও ব্রিটিশ যুগে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও অজ্ঞতার ফলে জাতিতে জাতিতে বিদ্রোহ শুরু হয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপমান, খুন ইত্যাদি দ্বারা সমাজে উৎসৃঙ্খলতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয়। সমাজে এই স্বেচ্ছাচারীদের বলা হতো দস্যু বা চন্ডাল। ব্রাহ্মণ হোক বা শূদ্র, যে স্বেচ্ছাচারী পরধণ লোলুপ, নির্দয়ী ব্যক্তিকে বলা হয় চন্ডাল ।
এদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হয়েছিলো। মূলত এরা এই নিষ্কাশিত ব্রাহ্মণ বা সমাজে নিন্দিত ব্যক্তি বর্গ। যারা হীন কর্ম দ্বারা যেমন কুকুর, গরু, নর মাংস ভক্ষণ, অপবিত্র হয়ে মদ্য পান করে নিন্দিত হয়েছে। এদের স্বপচ বলা হয়েছে।
এদের সমাজে স্থান ছিলো শূদ্রের নিচে। মূল সমাজ থেকে যাতে এরা বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। তাই এদের কর্ম দেওয়া হলো, রাজার দেওয়া মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত আসামিকে সাজা দেওয়া, মৃত ব্যক্তির দেহ সৎকার, রাস্তা পরিষ্কার করা ইত্যাদি। মূলত এরাই অস্পৃশ্য বা অন্ত্যজ বলে পরিচিত ছিলো। মনু স্মৃতির দশম অধ্যায় এদের তথ্য পাওয়া যায়।
ম্লেচ্ছ অনার্য জাতির উৎপত্তি
ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ভারতের ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি পর্যালোচনা করে আর্য ও অনার্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই আর্য ইনভেশন থিয়োরি দিয়ে ভারতীয় জনমানসে জাতিগত বিদ্বেষের পথ প্রশস্ত করে গেছে ।
পুরাণ ও তন্ত্র অনুসারে ম্লেচ্ছরা বৈদিক সনাতন বহির্ভূত। শ্রী কৃষ্ণ ও যবন রাজার যুদ্ধ প্রমাণ করে যে দ্বাপর যুগ থেকেই হিন্দু ধর্ম ছাড়াও অন্য ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। এই যবন ম্লেচ্ছরা ছিলো অনার্য।
আমাদের দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বিতাড়িত হয়ে চন্ডাল, অন্ত্যজ জাতির বংশধর ভারতের বাইরে ম্লেচ্ছ সংস্কৃতি বা অনার্য সংস্কৃতি তৈরী করেছিল। এর প্রমাণ আছে। এই ম্লেচ্ছদের দেশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র নেই। অর্থাৎ, ম্লেচ্ছ দেশে জোর যার মুলুক তার। রাজাই পুরোহিত।
পশু শিকার ও দল বেঁধে লড়াই করা, শিকারী পশু পালন করা, ইত্যাদি ছিলো এদের সামাজিক ব্যবস্থা। এদের পরিধান ছিলো কালো কাপড়, মৃত পশুর ছাল, মৃত ব্যক্তির সম্পদ ইত্যাদি। এভাবে শক, হুন, যবন ইত্যাদি বহির্গত জাতির জন্ম হয়েছে আমাদের নিষ্কাশিত নিষিদ্ধ জাতি থেকে।
এই ম্লেচ্ছ জাতিরা বৈদিক দেবতাদের অনুকরণে প্রকৃতির শক্তিদের বিভিন্ন দেবতা হিসেবে পূজা অর্চনা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে রোমান, আরেমনিয়া, জোরোঅস্ট্রিয়ান, গ্রীক ইত্যাদি ধর্মের উদ্ভব হয়।
আরো ভালো করে পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, এক দেশের দেবতা আরেক দেশের দেবতার বিপক্ষ। জোরোঅস্ট্রিয়ান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় দেখুন। সেখানে অসুরদের কল্যাণকারী এবং দেবতাদের অকল্যাণকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অঙ্গীরা মাইনু অর্থাৎ অঙ্গিরাক মুনিকে অগ্নী দূষক বলা হয়েছে। ইয়াজিদি ধর্মের দেবতা মেলেক তাউস এবং ইসলাম ধর্মের শয়তান একই ব্যক্তি। এই সংস্কৃতি গুলিতে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়।
পরবর্তীতে এরাই অনার্য সংস্কৃতি তৈরী করে আর্য সংস্কৃতিকে আক্রমন করতে থাকে। আমাদের হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে এই শক, হুন, যবন জাতিদের অনার্য বলা হয়েছে। মুসলিম বা খ্রিস্টান সম্পর্কে যবন ও ম্লেচ্ছ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
আজ আমাদের সমাজের সেই সুন্দর ধর্মীয় কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে। সেই ভয়টাই ঋষিরা এক সময় অনুমান করতে পেয়েছিলেন। তাই সমুদ্র বা নিজ ক্ষেত্র অতিক্রম করে বিদেশ যাত্রা নিষেধ করা হয়েছিল, যবন ম্লেচ্ছ দের সঙ্গে মিত্রতা নিষেধ করেছিল। যার ফল আমরা আজ ভোগ করছি।
বক্তব্যের প্রমাণ
ভারতীয় গ্রন্থ ও ধর্মীয় পুস্তক গুলোতে ভারত ছাড়াও ভারতের বাইরের দেশের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমী দেশ গুলোতে তাদের ধর্ম শাস্ত্রে বা গল্প কাহিনীতে ভারত বা হিন্দু ধর্মের কোনো কথা উল্লেখ নেই। তাঁদের ধর্মীয় কাহিনীতে মানুষকে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত করা। শয়তান দ্বারা বুদ্ধি বিভ্রাট করার কাহিনী আছে।
এভাবেই আমরা দেখতে পাই গ্রীক, রোম, ইত্যাদি দেশের দেবতারা পাহাড়ের চূড়ায় বাস করতো। রাজা বা ফেরাউন নিজেকে ঈশ্বরের মতো প্রস্তুত করতো। এর পর আব্রাহামের হাত ধরে ফেরাউন এর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আব্রাহামিক ধর্ম সৃষ্টি হলো। সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে সেটি প্রচার হলো।এই আব্রাহামিক ধর্ম গুলো হলো ইসলাম, খ্রীষ্টান এবং ইহদি।
আমরা এই সব ধর্ম সংস্কৃতি পর্যালোচনা করলে জানতে পারবো, এই সকল ধর্মের মূলে যে ঈশ্বর আছেন তিনি একই সনাতন ধর্মের ঈশ্বর। আমরা সকলেই সেই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের সৃষ্ট। আমাদের দেশ কাল ও পরিস্থিতি অনুসারে ধর্মের পার্থক্য তৈরী হয়েছে। তিনি ব্রহ্ম, আত্মা, প্রণব, কৃষ্ণ, শিব, তারা, ইত্যাদি নামে পরিচিত।
উপসংহার
প্রাচীন ভারতে বর্ণ-ব্যবস্থা মূলত গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে তৈরি হলেও, কালের প্রবাহে তা জন্ম-ভিত্তিক কঠোরতায় রূপ নেয়। ফলে সমাজে জাতিভেদ ও বৈষম্য জন্ম নেয়। অথচ, বাল্মীকি, ব্যাস, বিদুর, সুরদাস, ও পরাক্রমী কর্ণের মতো মহৎ ব্যক্তিদেরও, তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় নাই।
বর্ণসংকর শুধু ভিন্ন বর্ণের মিলনের ফলে সৃষ্ট নয়; সমাজের শৃঙ্খলা, ধর্মাচরণ ও নৈতিকতার বিচ্যুতি ঘটলেই প্রকৃত অর্থে বর্ণসংকরতা সৃষ্টি হয়।
শাস্ত্রের মূল শিক্ষা হল, মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হওয়া উচিত তার গুণের ভিত্তিতে। কর্মের ভিত্তিতে নয়।
অতএব, আমাদের উচিত ধর্ম কার্যে জন্মগত এবং ব্যবহারিক কার্যে মানুষের যোগ্যতা, গুণ ও কর্মকেই প্রধান মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা, যাতে সমাজে ন্যায়, সাম্য ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। এই বলেই আমরা এই আলোচনা এখানেই শেষ করবো।
0 Comments: