
NRC যদি নাগরিক পঞ্জিকরণ হয় তাহলে ভোটের লিস্ট কি? | If NRC is a citizen registration, what is the voter list?
অনেক কেই বলতে শুনেছি— “NRC যদি নাগরিক পঞ্জিকরণ হয় তাহলে ভোটের লিস্ট কি?” বা “যারা ভোট দিয়ে সরকার তৈরী করেছে, তারা কি বৈধ প্রার্থী?”, “এতদিন যারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে তারা ভারতীয় নয়? 😳 এটা কেমন কথা?”
আসুন, আজ এই সকল প্রশ্নের জবাব আমি আপনাদের স্পষ্ট ও সহজ ভাবে দেবো। প্রথমে আপনাকে বুঝতে হবে, ভারতের নাগরিকত্ব আইন সব সময় একই ছিল না, আর আইনের সূক্ষ্ম পরিবর্তনের কারণে অনেকে হয়তো বুঝতেই পারেননি যে তাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শর্ত প্রযোজ্য। 1950, 1992, 2004—প্রতিটি সময়ে আইন সংশোধন হয়েছে।
NRC এবং ভোটার তালিকা মূলত দুটি আলাদা উদ্দেশ্যে তৈরি হয়। NRC বা National Register of Citizens হলো দেশের সব বৈধ নাগরিকের একটি স্থায়ী রেকর্ড, যেখানে নাম ওঠার জন্য নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়— যেমন জন্ম সনদ, পিতামাতার নাগরিকত্বের প্রমাণ, স্কুল পাশ সার্টিফিকেট ইত্যাদি।
অন্যদিকে ভোটার তালিকা তৈরি হয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের জন্য, যেখানে শর্ত হলো ভারতীয় নাগরিক হওয়া, অন্তত ১৮ বছর বয়স, এবং নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হওয়া।
ভোটার তালিকা প্রতি বছর আপডেট হয় এবং তুলনামূলকভাবে কম নথি যাচাই করা হয়, ফলে ভুল বা জাল নাম ঢোকার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে ভোটার তালিকা নাগরিকত্বের সরাসরি প্রমাণ নয়, বরং ভোটাধিকার প্রমাণ করে; আর NRC নাগরিকত্বের সরকারি রেজিস্ট্রি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভোটার কার্ড আপনার নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়
ভারতের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত প্রাথমিক বিধান ভারতীয় সংবিধানের ধারা ৫ থেকে ১১ এবং Citizenship Act, 1955-এ দেওয়া আছে।
প্রধান শর্তগুলো হলো:
1. জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব (Citizenship by Birth)
২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১ জুলাই ১৯৮৭-এর মধ্যে ভারতে জন্ম নিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিক।
১ জুলাই ১৯৮৭-এর পরে জন্মালে অন্তত একজন পিতামাতা ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পরে জন্মালে, একজন পিতামাতা ভারতীয় নাগরিক এবং অপরজন অবৈধ অভিবাসী না হলে নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে।
2. বংশসূত্রে নাগরিকত্ব (Citizenship by Descent)
বিদেশে জন্ম হলেও, পিতামাতা ভারতীয় নাগরিক হলে নির্দিষ্ট শর্তে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। বিদেশে জন্মের ক্ষেত্রে শুধু পিতামাতার নাগরিকত্ব থাকলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব মেলে না— কারণ, ভারত দ্বী নাগরিকত্ব নেই।
৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পরে জন্ম হলে পিতামাতার অন্তত একজন ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং বিদেশে ভারতীয় দূতাবাস/কনসুলেটে জন্ম রেজিস্ট্রি করতে হবে—সাধারণত জন্মের এক বছরের মধ্যে।
২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর মধ্যে জন্ম হলে পিতামাতার মধ্যে যে কোনো একজন ভারতীয় নাগরিক হলে সন্তানও ভারতীয় নাগরিক হবে।
১০ ডিসেম্বর ১৯৯২ থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর মধ্যে জন্ম হলে, পিতামাতার উভয়ই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে, অথবা একজন নাগরিক এবং অপরজন নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য (illegal migrant নয়) হতে হবে।
প্রমাণপত্র হিসেবে পিতামাতার পাসপোর্ট, জন্ম সনদ, বিবাহ সনদ, এবং শিশুর জন্ম সনদ লাগে।
3. নিবন্ধন দ্বারা নাগরিকত্ব (Citizenship by Registration)
দীর্ঘ সময় ভারতে বসবাসকারী বিদেশি বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা আবেদন করে নাগরিক হতে পারেন।
4. প্রাকৃতিকীকরণ দ্বারা নাগরিকত্ব (Citizenship by Naturalization)
সাধারণত ১১ বছর ভারতে বৈধভাবে বসবাসের পর নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়।
5. অধিগ্রহণ দ্বারা নাগরিকত্ব (Citizenship by Incorporation of Territory)
কোনো অঞ্চল ভারতের অংশ হলে, সেই অঞ্চলের বাসিন্দারা ভারতের নাগরিক হয়ে যান।
ভোটার আইডি কার্ড কি নাগরিকত্বের প্রমাণ?
আইনি দৃষ্টিতে: ভোটার আইডি (EPIC) প্রমাণ করে আপনি ভোটার তালিকায় আছেন, আর ভোটার তালিকায় নাম থাকার জন্য ভারতীয় নাগরিক হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ভোটার আইডি সরাসরি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়, কারণ—
- 1. ভোটার তালিকায় ভুল বা জাল তথ্য দিয়ে নাম ওঠা সম্ভব।
- 2. আদালত ও সরকারিভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য পাসপোর্ট, জন্ম সনদ, বা ন্যাচারালাইজেশন সার্টিফিকেট বেশি বৈধ ধরা হয়।
- 3.ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল বা সন্দেহ হলে শুধু ভোটার আইডি দিয়ে প্রমাণ মেলে না।
নাগরিকত্ব প্রমাণের সাধারণ নথি
নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য সাধারণত যেগুলো শক্ত প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়।
- ১. ভারতীয় পাসপোর্ট
- ২. সরকারি জন্ম সনদ (শর্তসাপেক্ষে)
- ৩. Citizenship Certificate বা Naturalization Certificate
সরকারি নথিতে নাগরিকত্ব উল্লেখ থাকলে (যেমন: কিছু নির্দিষ্ট আদালতের রায়)।
সহজভাবে বললে, আপনার নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি হতে হবে এমন কিছু যা “আপনি জন্মসূত্রে বা আইনগতভাবে ভারতীয়” তা অস্বীকার করার সুযোগ কমিয়ে দেয়। যেমন, পুরনো স্কুল রেজিস্টার, বোর্ড পরীক্ষার সনদ ইত্যাদিতে পিতামাতার নাম ও নাগরিকত্বের উল্লেখ থাকলে তা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কারণ, টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গিয়ে স্কুলে নাম লেখানো সম্ভব নয়।
অথবা সরকারি ভূমি বা সম্পত্তি রেকর্ড যা দীর্ঘদিন ধরে এক এলাকায় বসবাসের প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগে। কারণ জমি কিনতে বা বিক্রি করতে গেলেও পরোক্ষ ভাবে নাগরিকত্ব, বৈধতা বা জমির মালিকানা ইত্যাদি যাচাই করা হয়। যদি কেউ ঘুষ বা অন্য ভাবে জমি ক্রয় করে, বা সরকারি জমিতে অবৈধ ভাবে দখল করে বাস করে। তবে সেটাও ধরা পড়বে।
CAA ও NRC নিয়ে বিপক্ষের বিরোধিতা কোথায়?
২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী—
পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান ও পারসি ধর্মাবলম্বী যারা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর আগে ভারতে এসেছেন, তারা “অবৈধ অভিবাসী” হলেও সহজে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই সুযোগ রাখা হয়নি। বিপক্ষ দল ও কিছু কিছু মিডিয়া বলছে এই বৈষম্য নীতির দিয়ে হিন্দুত্ববাদী BJP সরকার ভারতীয় মুসলমানের তাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। বিপক্ষ দল বলছে CAA সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থী। ধর্ম দেখে নাগরিকত্ব দেওয়া হলে মুসলিম শরণার্থীরা বৈষম্যের শিকার হবেন। বিজেপি বলছে, CAA কোনো ভারতীয় মুসলিম নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় না, বরং “শরণার্থীদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে তাদের নথিভুক্ত করে”। অর্থাৎ NRC-তে যাদের “অবৈধ” বলা হয়েছিল, CAA অনুযায়ী তাদের মধ্যে অনেককে (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান ও পারসিদের) আবার বৈধ নাগরিক বানানো হবে—যদি তারা উল্লিখিত ধর্মের হয়।
স্থানীয়দের উদ্বেগ
অসম ও উত্তর-পূর্বের অনেক মানুষ (বিশেষত আসামিয়া ভাষাভাষী ও উপজাতি গোষ্ঠী) মনে করেন—
যদি প্রচুর অবৈধ অভিবাসীকে বৈধ করা হয়, তবে:
ভাষাগত প্রভাব: স্থানীয় ভাষার জায়গায় বাংলা বা অন্য ভাষার প্রভাব বেড়ে যেতে পারে।
সংস্কৃতির পরিবর্তন: খাদ্যাভ্যাস, উৎসব, ঐতিহ্য ইত্যাদিতে বাইরের প্রভাব বাড়বে।
জনসংখ্যা ভারসাম্য: স্থানীয় বনাম অভিবাসীর অনুপাত বদলে গিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা, জমি ও চাকরির প্রতিযোগিতা তীব্র হতে পারে।
আসামে NRC হওয়ার পর কি হলো?
৩১ আগস্ট ২০১৯-এ আসামের চূড়ান্ত NRC তালিকা প্রকাশিত হয়। মোট আবেদনকারী ছিল প্রায় ৩.৩ কোটি। এর মধ্যে ১৯ লক্ষ (প্রায় ৬%) মানুষের নাম বাদ পড়ে। বাদ পড়া মানে সরকারিভাবে তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ অপ্রতুল বা অগ্রহণযোগ্য ছিল।
বাদ পড়া মানুষের অবস্থা:
নাম বাদ পড়লেই সরাসরি “অবৈধ অভিবাসী” ঘোষণা করা হয়নি। তাদের Foreigners Tribunal (FT)-এ আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়। FT-তে প্রমাণ দিতে না পারলে, পরবর্তী ধাপে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা সম্ভব।
অনেক ক্ষেত্রে NRC নথি যাচাই নিয়ে বিতর্ক ওঠে—কারও জন্মসনদে ভুল বানান, কারও পিতামাতার নামের সাথে অসামঞ্জস্য, ইত্যাদি কারণে নাম বাদ গেছে। বাদ পড়া মানুষদের সামাজিকভাবে কলঙ্কিত হতে হয়েছে, বিশেষ করে যারা বহু বছর ধরে আসামে বসবাস করছিলেন।
উপসংহার:
NRC এখনো জাতীয় স্তরে চালু হয়নি, শুধু আসামে হয়েছে। বাদ পড়াদের চূড়ান্ত ভাগ্য এখনো আদালত ও সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। কিছু ডিটেনশন সেন্টার তৈরি হয়েছে— আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই লোকজন সেখানে পাঠানো হয়নি।
0 Comments: