বেদ, শাস্ত্র, গ্রন্থ এবং পূরাণ —এদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

বেদকে অনাদি, অপৌরুষেয় বলা হয়। বেদ কখনো কারো ওপর নাজিল বা অবতরণ হয়নি। বেদ করো লেখা বইও নয়। বেদ কথার অর্থ হলো জ্ঞান। প্রকৃত অর্থে ঐশ্বরিক জ্ঞান বলতে বেদকেই বলা উচিত। যেখানে প্রতিটি শব্দই ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মই শব্দ আকারে জগত রূপে প্রকট হয়েছে। উপনিষদের দৃষ্টিতে — সর্বং খালিদং ব্রহ্ম

full-width

তাই বেদ হোলো প্রকৃত বিজ্ঞান। কারণ, বিজ্ঞান কেউ রচনা করেনি। 

বেদ-শাস্ত্র-গ্রন্থ এবং পূরাণ
বেদ, শাস্ত্র, গ্রন্থ এবং পূরাণ

যা কিছু জানা যায়, তাহাই জ্ঞান। কোন কিছুকে বিশেষ রূপে জানলে তাকে বলা হয় বিজ্ঞান। কোনো কিছু জেনে যখন তার প্রয়োগ করা হয় তখন তাকে বিদ্যা বলে। বিদ্যা দুই প্রকার:— (১) পরা বিদ্যা ও (২) অপরা বিদ্যা।

অপরা বিদ্যা— হলো সেই বিদ্যা যার দ্বারা মানুষ নিজের জীবন নির্বাহ করে। যা প্রয়োগ করে সে জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করে।

পরা বিদ্যা—হলো সেই বিদ্যা যা লাভের পর আর কোন কিছুই লাভ করার বাকি থাকে না। জন্ম ও মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। 

বেদে এই দুই প্রকার বিদ্যার কথাই বলা হয়েছে। তাই, বেদকে যিনি যথার্থ জেনেছে, তিনি সব কিছুই জেনেছে।

সৃষ্টির আদিতে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, নিজের হৃদয়ে এক প্রকার কম্পন বা নাদ শুনতে পেলেন। সেই নাদ অ , উ এবং ম একত্রে প্রণব বা ॐ -কার বলে কথিত। সেই প্রণব নাদ থেকে একে একে স্বর এবং ব্যঞ্জন রাসি উৎপন্ন হয়। এদের দ্বারাই মাতৃকা বর্ণ উৎপন্ন হয়।

স্বর মাতৃকা

অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, 
ঋ, ৯, এ, ঐ, ও, ঔ, 
অং, অঃ

ব্যাঞ্জন মাতৃকা

কং, খং, গং, ঘং, ঙং
চং, ছং, জং, ঝং, ঞং 
টং, ঠং, ডং, ঢং, ণং
তং, থং, দং, ধং, নং 
পং, ফং, বং, ভং, মং

যং রং লং বং শং ষং সং হং ড়ং ঢ়ং য়ং 

এই মাতৃকা বর্ণ থেকেই ক্লীং, খ্রীং ...ভ্রীং ইত্যাদি বীজ মন্ত্র প্রকট হয়েছে। যেগুলো আসলে দেবতা রূপে বিভিন্ন বিদ্যা। বেদের এরকমই বহু গুহ্য বিদ্যা ও রহস্য আছে। এক জীবনে জানা যাবে না, বলেও শেষ করা যাবে না, 

নানারূপত্বাদ্ ব্রহ্ম উপাধিত্বেন দৃশ্যতে ।
মাযামাত্রমিতি জ্ঞাত্বা বস্তুতো নাস্তি তত্ত্বতঃ ॥ 
ব্রহ্মৈব লোকবদ্ভাতি ব্রহ্মৈব জনবত্তথা ।
ব্রহ্মৈব রূপবদ্ভাতি বস্তুতো নাস্তি কিঞ্চন ॥ 
ব্রহ্মৈব দেবতাকারং ব্রহ্মৈব মুনিমণ্ডলম্ ।
ব্রহ্মৈব ধ্যানরূপং চ সর্বং ব্রহ্মৈব কেবলম্ ॥ 

প্রথমে বেদকে শুনে শুনে মনে রাখা হতো। তাই একে শ্রুতি বলা হতো। পরবর্তীতে (দ্বাপর যুগে) ওই বেদকে ঋষি কৃষ্ণ-দৈপায়ন  দেবনাগরী লিপিতে লিখলেন এবং চারটি খন্ডে প্রকাশ করেন। যথা:- ঋকবেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদ ও অথর্ব। এই দ্বৈপায়ন ঋষি ১৮টি মহাপুরান রচনা করেছেন। এই বেদের মন্ত্র গুলো বিভিন্ন ঋষি ও দেবতা, ছন্দ ও সূক্তে লেখা। 

শাস্ত্র 

হিন্দু সনাতনী বৈদিক আর্য ঋষিরা ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম ওই বেদ জ্ঞানকে বংশ পরম্পরায় প্রচার করেছেন। বেদ কে প্রমাণ রেখে ঋষি ও বিজ্ঞগন শাস্ত্র রচনা করেছেন। যেমন: নৃত্যশাস্ত্র, সংগীত-শাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, বাস্তুশাস্ত্র ইত্যাদি। প্রাচীনকালে এই শাস্ত্র গুলোই ভারতবর্ষের নৃত্য, কলা, ভাস্কর্য, সংগীত, সমাজ ও রাজনীতির বিজ্ঞান ছিল। আমরা শুধুমাত্র বেদে থেমে থাকিনি। পাণিনীর ব্যাকরণ থেকে শুরু করে, আর্যভট্টর সূর্যসিদ্ধান্ত পর্যন্ত সব শাস্ত্রে বেদ কে প্রমাণ ধরা হয়েছে। এমনকি বেদের সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করেও বৈশেষিক আদি শাস্ত্র গুলোকেও হিন্দুরা সমাদরে গ্রহণ করেছে।

পূরাণ:

চরাচর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা যা কিছু দর্শন করছি, সেই সকল ভৌত, এবং যা কিছু আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয়। সেই সকল স্থূল এবং সূক্ষ তত্ত্বগুলোকে  গল্প আকারে যে ধর্ম শাস্ত্রে সর্বসাধারণের জন্য তুলে ধরা হয়েছে তাকে আমরা পুরাণ বলে থাকি। পৌরাণিক কাহিনী গুলো সত্য হলেও বাস্তব নয়। বাস্তব নয় এই জন্য, কারণ এগুলো বিভিন্ন ঘটনা কে উপমা বা তুলনা আকারে লেখা হয়েছে। বেদের গুহ্য তত্ত্বকে গল্পের ছলে সর্বসাধারণের মনে মননের জন্য এবং চিত্তে চিন্তনের জন্য পুরাণ লেখা হয়েছে। যেমন, মা কালির গল্পে রক্তবীজের রক্ত পান করে খড়গ ও মুন্ডু হতে মা কালি মহাকালের বুকে পা দিয়ে জীভ বের করে আছেন। এই রূপ দেখে অনেকেই ভয় পায়। আসলে এটি একটি উপমা। অশুর রক্তবীজ আসলে আমাদের কামনা বাসনা, যা কখনো ধ্বংস হয় না। শিবের মতো নিজেকে মায়ের পায়ে সমর্পণ করলে তিনি ওই কাম ও ক্রোধ দমন করে, সব রসনা পান করে ভক্তকে অভয় দান করেন। এই মা কালি কুণ্ডলিনী শক্তি রূপে আমাদের দেহেই আছেন। যোগের দ্বারা তিনি জাগ্রত হন। কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হলে মানুষের মধ্যে দেবত্ব আসে। এই ভাবে পৌরাণিক কাহিনী গুলো সত্য। 

গ্রন্থ ও কাব্য

শাস্ত্র গুলোতে যে সব সূত্র বা শ্লোক আছে। সে গুলো উদ্ধৃতি করে যখন কোনো পণ্ডিত কোনো অন্য কোনো পুস্তক লেখেন। সেই পুষ্টককে গ্রন্থ বলা হয়। গ্রন্থ দুই প্রকার (১)ইতিহাস গ্রন্থ ও (২)কাব্য গ্রন্থ। ইতিহাস ও কাব্যগ্রন্থ উভয়তেই শাস্ত্রের উদ্ধৃতি থাকে। তবে জেনে রাখতে হবে, সকল কাব্যই গ্রন্থ কিন্তু সকল গ্রন্থ কাব্য নয়। যিনি ত্রিকালদর্শী, তাকেi কবি বলা হতো। সেই কবি যে কাব্যগ্রন্থ রচনা করে তাহাই  অমৃত। যিনি কবিতা লিখেন তিনি কবি নন। কবিতা মনোরঞ্জন করে মাত্র। গ্রন্থ ও কাব্যর উদ্দেশ্য হলো সমাজকে সংস্কার দান করা।

সংস্কার প্রাপ্ত সমাজকেই সংস্কৃতি বলা হয়। অপসংস্কার থেকে অপসংস্কৃতির জন্ম নেয়। অপসংস্কৃতি থেকে কুসংস্কার বৃদ্ধি পায়। কুসংস্কার বৃদ্ধি পেলে সমাজের পতন হয়। সমাজের পতন হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। রাষ্ট্রের ক্ষতি হলে শত্রুর বল বৃদ্ধি হয়।

উপসংহার:

সনাতন ধর্মের বিভিন্ন বিশ্লেষন মূলক আলোচনা ও পোস্ট দ্বারা আমার এই ব্লগ সাইটকে সাপোর্ট করুন। Follow করুণ আমাদের blog Website কে। ভালো লাগলে Share করুন। কমেন্ট করুন “জয় গুরু”, “ভারত মাতার জয়।”








1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds