সনাতন হিন্দু ধর্ম ও তন্ত্র: পঞ্চ ম-কার সাধনা


কৃতে শ্রুত্যুক্তমার্গঃ স্যাৎ ত্রেতয়াং স্মৃতিসম্ভবঃ ।
দ্বাপরে তু পুরানোক্ত কলাবাগমসম্মতঃ ॥ (তন্ত্রসার)

সত্য যুগে বেদ ক্রেতা যুগে স্মৃতি কাপড়ে পোড়ান এবং কলিযুগে তন্ত্র বিধি- অনুসারে ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। 

তন্ত্র খুব আধুনিক একটি বিষয় নয়, বৈদিক যুগেও তন্ত্র ছিলো। তন্ত্রের মূল দেবীরা হলেন দশ মহাবিদ্যা।  এদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলেন মা তারা, মা কালী ও মা কামাখ্যা। কারণ আদ্যা শক্তির শক্তিতেই সকল জগৎ চালিত, তাঁর মায়ায় মোহিত, তিনি সকলকে পাশ বন্ধনে বেঁধে রেখেছেন। এমনকি মহাকালও তাঁর পদ তলে শব হয়ে পরে আছেন। তন্ত্রের বিশালতা এক টি প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমার গুরু শ্রী শ্রী ঠাকুর নিগমানন্দ পরম হংস দেবের তান্ত্রিক গুরু গ্রন্থে তিনি খুব সুন্দর ও বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পাঠক সেই পুস্তক পাঠ  করলে খুব সহজেই তন্ত্র সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হবেন। 

ভূমিকা: 

প্রাচীন হিন্দু ধর্ম এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক গভীর এবং রহস্যময় অংশ হলো তন্ত্র। বেশিরভাগ মানুষের কাছে তন্ত্র মানেই হয়তো কালো জাদু বা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের এক ভয় জাগানো ধারণা। কিন্তু সত্য হলো, তন্ত্র হলো এক সুপ্রাচীন এবং শক্তিশালী আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান, যা বেদ-এর মতোই সনাতন হিন্দু ধর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি মূলত শক্তি বা দেবী উপাসনার মাধ্যমে জাগতিক ও পারমার্থিক মুক্তি লাভের পথ দেখায়। এই বিশেষ তান্ত্রিক পথে এমন কিছু বিশেষ সাধনা বা আচারের প্রচলন আছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে রহস্যে আবৃত। এই আচারের মধ্যে অন্যতম হলো পঞ্চ ম-কার সাধনা। কিন্তু এই পঞ্চ ম-কার কী? কেনই বা এত কঠোরভাবে এর চর্চা করা হয়? এই প্রবন্ধে আমরা এর আক্ষরিক ও প্রতীকী অর্থকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব, যাতে হিন্দু ধর্ম এর এই গভীর দিকটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ এবং সম্পূর্ণ ধারণা তৈরি হয়। এটি কেবল একটি আচারের বর্ণনা নয়, বরং সনাতন হিন্দু দর্শনের এক গভীর উপলব্ধি।

১. তন্ত্র কী? সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রেক্ষাপট

সনাতন হিন্দু ঐতিহ্য হাজার হাজার বছরের প্রাচীন। এই বিশাল ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি হলো বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণ। কিন্তু এর পাশাপাশি, বিশেষ করে শক্তি (দেবী) উপাসনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তন্ত্র শাস্ত্র। এটি এমন এক পদ্ধতি, যা সাধারণ মানুষের জাগতিক সমস্যা, যেমন রোগমুক্তি, সম্পদ লাভ বা বিপদ থেকে রক্ষা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক লক্ষ্য, অর্থাৎ মোক্ষ বা মুক্তি লাভে সাহায্য করে।

ক. তন্ত্রের সংজ্ঞা এবং মূলনীতি

'তন্ত্র' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো 'বিস্তার করা' বা 'রক্ষা করা' (তন + ত্রৈ)। অর্থাৎ, যে শাস্ত্র জ্ঞানের বিস্তার করে এবং মানুষকে দুঃখ থেকে রক্ষা করে, তাই তন্ত্র। তন্ত্রের মূল নীতি হলো:

  • শক্তি উপাসনা: তন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলেন দেবী বা শক্তি। শক্তিকে ব্রহ্মের সক্রিয় রূপ হিসেবে দেখা হয়।
  • কর্ম ও ফল: এটি বিশ্বাস করে যে জাগতিক জীবনকে এড়িয়ে না গিয়ে, এর মাধ্যমেও মুক্তি লাভ করা যায়।
  • গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তান্ত্রিক সাধনা কেবল একজন উপযুক্ত গুরুর নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানেই সম্ভব।
  • দেহ-কে-মন্দির: তন্ত্র বিশ্বাস করে যে মানবদেহ হলো ব্রহ্মাণ্ডের একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ বা মন্দির। এর মধ্যেই সকল দেব-দেবী এবং কুণ্ডলিনী শক্তি বিরাজমান।

খ. বেদ ও তন্ত্র: সম্পর্ক ও পার্থক্য

বেদ এবং তন্ত্র উভয়ই হিন্দু ধর্ম এর আদি এবং অনুমোদিত শাস্ত্র। তন্ত্রকে অনেক সময় 'পঞ্চম বেদ' বা বেদের ব্যবহারিক দিক হিসেবে দেখা হয়। বেদের জ্ঞান যেখানে মূলত তাত্ত্বিক, তন্ত্র সেখানে সেই জ্ঞানকে সরাসরি প্রয়োগের পথ দেখায়।

আচার: বেদ মূলত বৈদিক যজ্ঞ, মন্ত্র এবং সামাজিক নিয়ম-ভিত্তিক। তন্ত্র আচার-অনুষ্ঠান, দীক্ষা, মুদ্রা (gesture) এবং মন্ত্রের উপর জোর দেয়। তন্ত্রে ৭ প্রকার আচার আছে যথা: বেদাচার, বৈষ্ণবাচার, দক্ষিণাচার, বামাচার, সিদ্ধাচার ও কৈলাচার। সাধককে বেদাচার থেকে শুরু করতে হয় এবং কৈলাচার প্রাপ্ত হয়ে মোক্ষ লাভ করেন। 

যোগমার্গং কৈল মার্গমেকাচারক্রমঃ প্রভো । 
যোগী ভূত্বা কুলাং ধ্যাত্বা সর্বসিদ্ধীঈশ্বরো ভবেৎ ॥ (রুদ্রযামল )

অর্থাৎ: হে প্রভু! যোগ সাধন ও কৌল সাধনা একই প্রকার, কারন কৌল ব্যাক্তি যোগী হয়ে কুল ( কুণ্ডলিনী) ধ্যান পূর্বক সমুদয় সিদ্ধি লাভ করেন। 

অধিকার: বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একসময় লিঙ্গ বা বর্ণভেদ ছিল। কিন্তু তন্ত্র ঘোষণা করে যে, উপযুক্ত দীক্ষা ও গুরু লাভের পর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তান্ত্রিক সাধনা করার অধিকার রাখেন।

উদ্ধৃতি: তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, "যথা দেবী তথা গুরু" (যেমন দেবী, তেমনই গুরু)। গুরুর মাধ্যমেই শিষ্যের মধ্যে দিব্য শক্তি সঞ্চারিত হয়।

গ. তন্ত্রের প্রধান ধারা: দক্ষিণাচার ও বামাচার

তান্ত্রিক সাধনার সপ্ত  আচার সম্পর্কে আগেই বলেছি তার মধ্যে প্রবৃতি  ও নিবৃতি  মার্গের ভীতিতে মূলত দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত:

দক্ষিণাচার (Right-hand path): এটি অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল এবং সমাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে চলে। এখানে পঞ্চ ম-কার এর প্রতীকী ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়। দেবী উপাসনা এবং যোগের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শুদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়। এই ধারাটি সনাতন হিন্দু সমাজের বৃহত্তর অংশ দ্বারা গৃহীত।

বামাচার (Left-hand path): এই ধারায় কঠিন এবং সমাজের চোখে 'নিষিদ্ধ' কিছু আচারের আক্ষরিক অনুশীলন করা হয়, যার মধ্যে পঞ্চ ম-কার সাধনা অন্যতম। এই তান্ত্রিক সাধনার উদ্দেশ্য হলো 'ভয়', 'ঘৃণা' বা 'কামনা'-র মতো দ্বৈততাগুলিকে সরাসরি মোকাবিলা করে সেগুলিকে অতিক্রম করা এবং দ্রুত মোক্ষ লাভ করা। এটি অত্যন্ত বিপদজনক এবং অল্প সংখ্যক সাধকই এর চর্চা করেন।

২. পঞ্চ ম-কার সাধনা: পাঁচ 'ম' এর রহস্য

পঞ্চ ম-কার (সংস্কৃত: Panchamakara) হলো তান্ত্রিক সাধনার একটি বিশেষ অংশ। এই পাঁচটি উপাদান বা আচারের নাম 'ম' অক্ষর দিয়ে শুরু হয়, তাই একে 'পঞ্চ ম-কার' বলা হয়। এই সাধনা টি তন্ত্রের বামাচার ধারায় প্রচলিত হলেও, এর প্রতীকী অর্থ দক্ষিণাচার এবং যোগের ক্ষেত্রেও গভীর তাৎপর্য বহন করে। এটি হলো সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যের এক চরম পরীক্ষা।

ক. পঞ্চ ম-কারের আক্ষরিক পরিচয়

আক্ষরিকভাবে এই পাঁচটি 'ম' হলো:

  • মদ্য (Madya): মাদক দ্রব্য, যেমন সুরা বা ওয়াইন।
  • মাংস (Mamsa): যেকোনো ধরণের মাংস।
  • মৎস্য (Matsya): মাছ।
  • মুদ্রা (Mudra): ভাজা বা শুকনো শস্য (যেমন মুড়ি, চিঁড়ে)।
  • মৈথুন (Maithuna): স্ত্রী-পুরুষের মিলন বা যৌন ক্রিয়া।

খ. কেন এই আচারের সৃষ্টি?

এই পাঁচটি উপাদান বা আচারের পিছনে তান্ত্রিক দর্শন কী? কেনই বা হিন্দু ধর্ম এর এই অংশে এমন চর্চার কথা বলা হয়েছে?

  1. দ্বৈততা অতিক্রম: সমাজ এবং শাস্ত্র যে বিষয়গুলিকে সাধারণত 'পাপ' বা 'নিষিদ্ধ' বলে মনে করে, একজন তান্ত্রিক সাধক সেইগুলির মুখোমুখি হন। এর উদ্দেশ্য হলো ভালো-মন্দ, পবিত্র-অপবিত্র— এই দ্বৈত ধারণাগুলিকে মন থেকে মুছে ফেলা। যখন সাধক এই নিষিদ্ধ জিনিসগুলি গ্রহণ করেও নিজের মনকে স্থির রাখতে পারেন, তখনই তিনি জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্ত হন।
  2. শক্তি জাগরণ: তান্ত্রিক সাধনা বিশ্বাস করে যে, যখন মানুষ চরম জাগতিক ভোগের মাঝখানেও নিজেকে ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত রাখতে পারে, তখন তার মধ্যে সুপ্ত কুণ্ডলিনী শক্তি দ্রুত জাগরিত হয়।
  3. জীবন্ত মুক্তি: সাধারণ সনাতন হিন্দু বিশ্বাসে মুক্তির জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু তন্ত্রে বলা হয়, একজন সাধক জীবদ্দশাতেই এই সাধনার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করতে পারেন।


Alt Text: হিন্দু ধর্মের কুণ্ডলিনী শক্তি ও চক্রের প্রতীকী চিত্রণ

৩. প্রত্যেক 'ম'-কারের বিশদ বিশ্লেষণ (আক্ষরিক বনাম প্রতীকী)

সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যে পঞ্চ ম-কারের ব্যাখ্যা দুই ধরণের – আক্ষরিক (যা সাধারণত বামাচারী করে) এবং প্রতীকী (যা দক্ষিণাচারী ও যোগীরা করেন)। আমরা এখানে এই দুই ধরণের ব্যাখ্যাই দেখব, যা তান্ত্রিক সাধনার প্রকৃত মর্ম বুঝতে সাহায্য করবে।

ক. মদ্য (Madya): আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রতীকী ব্যাখ্যা

দেবী বা ভৈরবের উদ্দেশ্যে সুরা বা মদ নিবেদন ও পান করা হয়। এই 'মদ্য' হলো সেই অভ্যন্তরীণ আনন্দের প্রবাহ, যা সহস্রার চক্রে শিব-শক্তির মিলনে উৎপন্ন হয়। এটি অজ্ঞানের নেশা নয়, বরং জ্ঞানের চরম উপলব্ধি।

  • উদ্দেশ্য: সমাজের নিষিদ্ধ বস্তু গ্রহণ করে মনের ভয় দূর করা 
  • যোগ: কুণ্ডলিনী যোগের মাধ্যমে যোগীর দেহ-মন থেকে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে দিব্য জ্ঞানকে গ্রহণ করা। |

খ. মাংস (Mamsa): আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রতীকী ব্যাখ্যা |

পশু বা মাছের মাংস: দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া পশু বা মাছের মাংস ভক্ষণ। 'মাংস' শব্দটি সংস্কৃত 'মা' (জিহ্বা) এবং 'অংস' (অংশ) থেকে এসেছে। প্রতীকীভাবে এটি বোঝায় বাক্য সংযম এবং জিহ্বার দ্বারা সকল প্রকার মিথ্যা ও কঠোরতা ত্যাগ করা।

  • উদ্দেশ্য: ভোগ ও অভোগের দ্বৈততা ভেঙে ফেলা।
  • যোগ: ক্রোধ, ঘৃণা, লোভ – এই পশু-স্বভাবের মতো রিপুগুলিকে বলি দিয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করা।

গ. মৎস্য (Matsya): ইন্দ্রিয় সংযম আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রতীকী ব্যাখ্যা 

মাছের মাংস ভক্ষণ। | প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণ: 'মৎস্য' হলো আমাদের প্রাণবায়ু। তান্ত্রিক সাধনায় মৎস্য মানে হলো ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ির মাধ্যমে প্রবাহিত প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং এটিকে সুষুম্না নাড়িতে চালিত করা। |

  • উদ্দেশ্য: খাদ্যের মাধ্যমে জাগতিক আসক্তি ত্যাগ করা। | 
  • যোগ: ইন্দ্রিয়গুলিকে (যা জলের মধ্যে মাছের মতো চঞ্চল) নিয়ন্ত্রণ করে মনের স্থিরতা আনা। এটিই আসল 'মৎস্য'। |

ঘ. মুদ্রা (Mudra): দিব্য ভাব বা যোগাভ্যাস আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রতীকী ব্যাখ্যা |

সাধারণত ভাজা শস্য বা রুটি। এটি হলো সত্য ও দিব্য ভাবকে ধারণ করা। 'মুদ্রা' হলো মনের সঠিক ভাব বা ভঙ্গি। এটি বাহ্যিক কোনো শস্য নয়, বরং মানুষের ভেতরের ঐশ্বরিক ভাব। 

  • উদ্দেশ্য: সাধারণ খাবারের প্রতি আসক্তি ত্যাগ। 
  • যোগ: যোগের মুদ্রা বা হাত-পা-শরীরের বিশেষ ভঙ্গি যা অভ্যন্তরীণ শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। যেমন – জ্ঞান মুদ্রা, খেচরি মুদ্রা ইত্যাদি। এই তান্ত্রিক সাধনা শরীরের অভ্যন্তরে শক্তি জাগরিত করে। 

ঙ. মৈথুন (Maithuna): শিব-শক্তির মহামিলন আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রতীকী ব্যাখ্যা 

এটিই পঞ্চ ম-কারের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বামাচারী তান্ত্রিক সাধনায় উপযুক্ত সহচরী বা সহচরের সাথে এক বিশেষ পবিত্র স্থানে এবং সময়ে যৌন মিলন করা হয়। | শিব-শক্তির মিলন: এই 'মৈথুন' হলো মানুষের দেহের অভ্যন্তরে কুণ্ডলিনী শক্তিকে (যা নারী শক্তি বা শক্তি নামে পরিচিত) জাগরিত করে তাকে সহস্রার চক্রে স্থিত শিবের সঙ্গে মিলিত করা। এটিই অভ্যন্তরীণ চরম আধ্যাত্মিক মিলন। 

  • উদ্দেশ্য: মানবীয় কামকে ঐশ্বরিক প্রেমে রূপান্তর করে মোক্ষ লাভ করা। |
  • যোগ: দ্বৈততা (পুরুষ-প্রকৃতি, সুখ-দুঃখ) অতিক্রম করে একত্বে বিলীন হওয়া। |

গুরুত্বপূর্ণ নোট: অধিকাংশ সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণাচার ধারায়, কেবল প্রতীকী ব্যাখ্যাই গৃহীত হয়। আক্ষরিক তান্ত্রিক সাধনা শুধুমাত্র কিছু বামাচারী গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

  ৪. তান্ত্রিক সাধনা ও আধুনিক জীবন: যোগ ও কুণ্ডলিনী শক্তি

হিন্দু ধর্ম এর এই গভীর তান্ত্রিক জ্ঞানগুলি আজও আধুনিক জীবনে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে যোগ ও কুণ্ডলিনী সাধনার মাধ্যমে।

ক. কুণ্ডলিনী যোগ ও পঞ্চ ম-কার

আধুনিক কুণ্ডলিনী যোগীরা পঞ্চ ম-কারকে সম্পূর্ণভাবে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেন। তাদের কাছে:

  •  মদ্য: হলো পরমানন্দের তীব্র অনুভূতি।
  •  মাংস: হলো মনের পশু-প্রবৃত্তিগুলিকে বলিদান।
  •  মৎস্য: হলো স্থির মন ও প্রাণায়াম দ্বারা শ্বাস নিয়ন্ত্রণ।
  •  মুদ্রা: হলো বিশেষ তান্ত্রিক শারীরিক ভঙ্গিমা যা চক্রগুলিকে সজাগ করে।
  •  মৈথুন: হলো মনের সর্বোচ্চ সাধনা, যেখানে শক্তি (কুণ্ডলিনী) তার মূল উৎস শিবের সঙ্গে মিলিত হয়।

এই সাধনা শরীর, মন এবং আত্মার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে, যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্ম-উপলব্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খ. আধুনিক সনাতন হিন্দু সমাজের দৃষ্টিতে তান্ত্রিক সাধনা

বর্তমানে সনাতন হিন্দু সমাজে তান্ত্রিক সাধনাকে দুটি ভিন্ন চোখে দেখা হয়:

  1. শ্রদ্ধা: তন্ত্রের মন্ত্র, যন্ত্র, এবং যজ্ঞের মাধ্যমে রোগমুক্তি, বিপদ থেকে রক্ষা এবং জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য এখনো অনেকেই তান্ত্রিক গুরুদের কাছে যান। দুর্গা পূজা, কালী পূজা ইত্যাদি শক্তি উপাসনাগুলি তন্ত্রের মাধ্যমেই হয়।
  2. সংশয়: বামাচারী সাধনার আক্ষরিক চর্চা নিয়ে সমাজে অনেক সংশয় এবং ভয় আছে, যা প্রায়শই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। তাই আধুনিক হিন্দু ধর্ম এর শিক্ষাবিদরা বেশিরভাগ সময় যোগের মাধ্যমে এর প্রতীকী অর্থকেই প্রচার করেন।

৫. পঞ্চ ম-কার সাধনা কি আইনত বৈধ?

আক্ষরিক অর্থে এই সাধনার কিছু উপাদান (যেমন মাদকদ্রব্য বা অস্বাভাবিক আচার) প্রচলিত সমাজের নিয়ম বা আইনি বিধিনিষেধের আওতায় আসতে পারে। তবে, প্রতীকী সাধনা, যেমন কুণ্ডলিনী যোগ, সম্পূর্ণ বৈধ এবং বিশ্বব্যাপী চর্চিত। এই তান্ত্রিক সাধনার মূল শক্তি এর প্রতীকী জ্ঞান, যা আত্ম-উন্নতির পথ দেখায়।

৬. উপসংহার: 

এই সম্পূর্ণ আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, হিন্দু ধর্ম একটি বিশাল এবং বহুস্তরের দর্শন। তন্ত্র এবং পঞ্চ ম-কার সাধনা সেই দর্শনের এক গভীর, কিন্তু সংবেদনশীল অংশ।

তান্ত্রিক সাধনা কখনোই অরাজকতা বা উচ্ছৃঙ্খলতাকে উৎসাহিত করে না। বরং, এটি একটি অত্যন্ত কঠিন এবং নিয়মতান্ত্রিক পথ, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো দ্রুততম সময়ে আত্ম-উপলব্ধি এবং মোক্ষ লাভ। সনাতন হিন্দু ঐতিহ্যে এর আক্ষরিক ব্যাখ্যাটি শুধুমাত্র কিছু উচ্চমার্গের তান্ত্রিক দ্বারা চরম গোপনীয়তার সঙ্গে চর্চা করা হয়, এবং সাধারণ মানুষ বা নতুন সাধকদের জন্য তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

সাধারণ হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের জন্য, পঞ্চ ম-কার একটি শক্তিশালী প্রতীকী শিক্ষা বহন করে: আমাদের জীবনের সকল জাগতিক উপাদান— তা ভোগ হোক বা ত্যাগ— সবকিছুকেই ব্যবহার করা যেতে পারে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম হিসেবে। আসল তান্ত্রিক সাধনা হলো ভেতরের পশুত্বকে (মাংস, মদ্য) বলি দিয়ে, ইন্দ্রিয়গুলিকে (মৎস্য) নিয়ন্ত্রণ করে, এবং দিব্য জ্ঞানকে (মুদ্রা) ধারণ করে, নিজের ভেতরের শিব ও শক্তির (মৈথুন) মিলন ঘটানো।

আপনার আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করার জন্য যোগ, ধ্যান এবং সঠিক গুরুর নির্দেশনা গ্রহণ করে এই সনাতন হিন্দু জ্ঞানকে জীবনে প্রয়োগ করুন।

কল টু অ্যাকশন (Call to Action)

আপনি কি সনাতন হিন্দু ধর্মের এই গভীর তান্ত্রিক জ্ঞানকে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে চান? যোগ, কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরণ বা মেডিটেশন বিষয়ে আমাদের পরবর্তী নিবন্ধের জন্য আমাদের সাইটটি অনুসরণ করুন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্ম দর্শনটি শেয়ার করুন!

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds