যে প্রশ্নগুলো পশ্চিমা ঈশ্বরকে হারিয়ে দেয়, সেগুলো অদ্বৈতে জলভাত।


ভূমিকা: 

আজ আমরা ক্লাসিক্যাল থিওলজিকাল সমস্য নিয়ে আলোচনা করবো। ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বরের ক্ষমতা ও তাঁর অনস্তত্বে প্রভাব। এই বিষয় গুলো আজকের আলোচ্য বিষয়। পশ্চিমা ধর্মে ঈশ্বরকে একটি ব্যক্তিগত সত্তা হিসেবে দেখা হয়, যা দুঃখের জন্য দায়ী। কিন্তু অদ্বৈতে দুঃখ মায়া—তোমারই সৃষ্টি। রামানুজ বা মধ্বের দ্বৈতবাদী দর্শনে ঈশ্বর আলাদা, কিন্তু অদ্বৈতে সব এক। এটি পশ্চিমা প্রশ্নগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক করে।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে কি?

হ্যা আছে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই জগত, অনুমান প্রমাণ হলো মহাপুরুষ ও বিভিন্ন ভক্তের সঙ্গে ঘটে যাওয়া আশ্চর্য কাহিনী এবং যোগ দ্বারা ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার করা সম্ভব।  ইশ্বর ভিন্ন কোনো দৈত্যাকার দিব্য পুরুষ নন বা ব্যক্তি সত্তা নন। তিনিই জগত সৃষ্টি করেননি, তিনি জগত হয়েছেন এবং তিনিই জগতকে আবৃত করে আছেন। অর্থাৎ তিনি এই জগতের মধ্যে আছেন এবং জগত থেকে একটু বেশী আয়তনে জগতের বাইরেও অবস্থান করছেন। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র মতে তিনি দশ আঙ্গুল অতিরিক্ত। কসমোলজিকাল আর্গুমেন্ট (বিশ্বের উৎপত্তি) বা ফাইন-টিউনিং আর্গুমেন্ট (বিশ্বের সূক্ষ্ম সমন্বয়) প্রায়ই উল্লেখ করা হয়, যদিও এগুলি বিতর্কিত এবং বিজ্ঞানীরা যেমন স্টিফেন হকিং বা রিচার্ড ডকিন্স এগুলিকে খণ্ডন করেছেন। নাস্তিক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিগ ব্যাং বা মাল্টিভার্স থিওরি ঈশ্বর ছাড়াই বিশ্বের ব্যাখ্যা দেয়।

হকিং বলেছিলেন: “Since time itself began at the Big Bang, there is no ‘before’. Asking what happened before the Big Bang is like asking what is north of the North Pole.”

হকিং-এর “The Grand Design” বইয়ে যে “নাথিং” থেকে বিশ্বের জন্মের কথা বলা হয়, সেটি দার্শনিকভাবে “absolute nothing” নয়। সেটি কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়াম—যেখানে শক্তি, ক্ষেত্র, এমনকি সময়ের সম্ভাবনাও আছে। অর্থাৎ: এটি “কিছু না” নয়, বরং “কিছু একটা” (Quantum vacuum + Laws of physics) থেকে কিছু হওয়া। ডেভিড অ্যালবার্ট, উইলিয়াম লেন ক্রেইগ, জন লেনক্স প্রমুখ এই বিন্দুতে হকিং-কে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। কারণ বিজ্ঞান পরীক্ষণযোগ্য এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য ঘটনা নিয়ে কাজ করে। 

হকিং এর “There is no time ‘before Big Bang”— এই তর্ক প্রমাণ বিহীন বক্তব্য মাত্র। আমরা বলছি এই জগতটাই ঈশ্বরের দেহ। এটি সনাতন হিন্দু ধর্মই বলতে পারেন। কারণ, খ্রীষ্টান, ইসলাম ও ইহুদী ধর্মের দৃষ্টিতে ঈশ্বর কখনো জগৎ হতে পারে না। তিনি স্রষ্টা এবং সৃষ্টি থেকে ভিন্ন। এই পশ্চিমা ঈশ্বর নিজেই নিজের অক্ষমতা বা সীমানা প্রকট করে। তাই, সর্ব শক্তিমানের যুক্তি এখানেই খন্ডিত হয়ে যাচ্ছে।

যেহেতু আমরা বলছি এই জগত ও ঈশ্বর অভিন্ন। ভগবত অবতার ভগবান শঙ্করাচার্যের শব্দের, “ন ইহ নানা অস্তি কিঞ্চন” জগতের কিঞ্চিৎ মাত্র তার থেকে ভিন্ন নয় সেখানে জগতটাই প্রমাণ। তাই, যখন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে তখন তাঁকে এই জগত থেকে ভিন্ন করে ভাবার প্রশ্নই আসে না। কারণ, প্রমাণ আমরা সেই বস্তুর দিতে পারি যা আমরা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরিমাপ করতে পরি। যুক্তির দ্বারা অনুধাবন করতে পরি। কিন্তু, যদি বলেন জগতের বাইরে কোনো প্রমাণ কি দেওয়া সম্ভব? সততার সঙ্গে এর উত্তর হলো না, সম্ভব নয়। কারণ সেটা সেই প্রমাণ হবে Etraordinary। অসাধারণ অভিজ্ঞতার জন্য অসাধারণ চেতনা প্রয়োজন, যা সাধারণ মানুষের নেই।

আরো সংক্ষেপে বললে, “যাকে প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে, সেই প্রমাণ করার যন্ত্রটিও তারই অংশ”। 

যদি ঈশ্বর সর্বজ্ঞ হয়, তাহলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কীভাবে সম্ভব?

প্রশ্নটি ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের একটি ক্লাসিক সমস্যা নিয়ে, যা "ফোরনোলেজ অ্যান্ড ফ্রি উইল" (foreknowledge and free will) নামে পরিচিত। এটি মূলত থিওলজিক্যাল ফ্যাটালিজম (theological fatalism) হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান স্বাধীনতাকে অসম্ভব করে তোলে। অর্থাৎ— ঈশ্বর সর্বজ্ঞ অর্থাৎ যদি ঈশ্বরের জ্ঞান অভ্রান্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যত পূর্ব নির্ধারিত, যা স্বাধীনতাকে অসম্ভব করে তোলে। কারণ ইহা পাশ্চাত্য ঈশ্বর ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রাচ্য অর্থাৎ ভারতে ঈশ্বর (ব্রহ্ম) এবং মানুষের ইচ্ছা অভিন্ন মনে করা হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।

সর্বজ্ঞতা ব্রহ্মের স্বভাব, কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা জীবের আপাত অভিজ্ঞতা। ব্রহ্মের স্বভাব অনুসারে তিনি সর্বদা সত্য ধারণ করে চলেন। অর্থাৎ যা ঘটবেই, এমন কিছু। কিন্তু জীব সেই সত্যকে উপেক্ষা করে মায়াকে ধরে চলে। যেমন, স্বপ্নে আপনি স্বাধীন ইচ্ছা অনুভব করেন, কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় বুঝতে পারেন যে সবকিছু আপনার মনেরই প্রকাশ। একইভাবে, জাগ্রত জগতে স্বাধীন ইচ্ছা মায়াময়, কিন্তু মোক্ষে (যখন আপনি ব্রহ্মরূপে উপলব্ধি করেন) এটি অদৃশ্য হয়ে যায়। মৃত্যুর পর এই সব ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনো গুরুত্বই থাকে না। তা আপনি হিন্দু বা খ্রীষ্টান বা মুসলমান যাই হোন না কেন মৃত্যুতে সব শেষ। এটাই ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা বা পূর্ব নির্ধারিত সত্য। 

এই কারণেই শঙ্করাচার্য বলেছেন: নাস্তি তত্ত্বং বিনা জ্ঞানং, নাস্তি জ্ঞানং বিনা তত্ত্বম্ (সত্য ছাড়া জ্ঞান নেই, জ্ঞান ছাড়া সত্য নেই।) 

দুষ্টতা এবং কষ্টের অস্তিত্ব কেন ঈশ্বরের সর্বকরুণাময়তার সাথে সাংঘর্ষিক?

দুষ্টতা এবং কষ্টের অস্তিত্ব নেই। হিন্দু দর্শনের মূল সারাংশকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। হ্যাঁ, হিন্দু ধর্মে "প্রবলেম অফ ইভিল" (দুষ্টতা এবং কষ্টের সমস্যা) পশ্চিমা মনোথেইস্টিক ধর্মগুলির (যেমন খ্রিস্টান বা ইসলাম) মতো প্রযোজ্য নয়, কারণ হিন্দুত্বে কোনো স্বতন্ত্র "শয়তান" (Satan) বা দুষ্টতার স্বাধীন সত্তার ধারণা নেই। পরিবর্তে, দুষ্টতা এবং কষ্টকে মানুষের নিজস্ব কর্ম, অজ্ঞানতা বা মায়ার ফল হিসেবে দেখা হয়।

ঈশ্বর সর্ব করুণাময় কিন্তু তিনি শুধুই করুণাময় এমনটাও নয়। তিনি ন্যায় ও নীতির ধারক। যার অর্থ নেই তার অভাবের কষ্ট, জাত অভাব নেই তার আরো অর্থ চাই, অর্থাৎ অভাব পূরণ হয়েওকষ্ট কম হয় না। এর জন্য ইস্বর দায়ী নয়। হিন্দু ধর্মে মানুষ নিজের কর্ম দিয়ে সুখ এবং দুঃখ সৃষ্টি বা নিবারণ করে। এটি "কর্মফল তত্ত্ব" (law of karma) এর উপর ভিত্তি করে, যা বলে যে প্রত্যেক কর্মের ফল (ভালো বা মন্দ) অবশ্যম্ভাবী। উপনিষদে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪.৪.৫) বলা হয় যে "যথা কর্ম যথা শ্রুতম্" (যেমন কর্ম, তেমন ফল)। কষ্ট পূর্বজন্মের কর্মের ফল, না ঈশ্বরের শাস্তি।

পশ্চিমা ধর্মগুলিতে শয়তান দুষ্টতার উৎস, যা ঈশ্বরের করুণাময়তাকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু হিন্দুত্বে, দুষ্টতা অভ্যন্তরীণ—যা মানুষ নিজে সৃষ্টি করে এবং নিবারণ করে। এটি হিন্দু ধর্মকে আরও স্বাবলম্বী করে তোলে, যেখানে মোক্ষ বা মুক্তি নিজের সাধনার উপর নির্ভর করে।

বিভিন্ন ধর্মের ঈশ্বর কি একই সত্তা, না ভিন্ন?

ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর মধ্যে সজাতীয়,  বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদ নেই। প্রশ্নটি ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের একটি বিতর্কিত বিষয়, যা বিভিন্ন ধর্ম এবং দার্শনিকদের মধ্যে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। নীচে আমি এটিকে সুষমভাবে বিশ্লেষণ করব, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে, যাতে আপনার মতামতের সাথে সামঞ্জস্য রাখা যায়।

ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বে এই প্রশ্নকে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: এক্সক্লুসিভিজম (exclusivism), ইনক্লুসিভিজম (inclusivism) এবং প্লুরালিজম (pluralism)।

এক্সক্লুসিভিজম (ভিন্ন সত্তা): অনেক ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে নিজের ধর্মের ঈশ্বরই একমাত্র সত্য, এবং অন্য ধর্মের দেবতা ভিন্ন বা অস্তিত্বহীন। উদাহরণস্বরূপ, কিছু খ্রিস্টান বা ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় যে অন্য ধর্মের দেবতা মানুষের কল্পনা বা ভুল ব্যাখ্যা। বাইবেলে (যেমন Exodus 20:3) "অন্য দেবতা" কে নিষিদ্ধ করা হয়, যা ইঙ্গিত করে যে অন্যান্য ধর্মের ঈশ্বর ভিন্ন। একইভাবে, কিছু ইসলামিক ব্যাখ্যায় আল্লাহকে একমাত্র বলা হয়, এবং অন্য দেবতা পলিথেইজমের অংশ।

ইনক্লুসিভিজম (আংশিকভাবে একই): এখানে নিজের ধর্মের ঈশ্বরকে সর্বোচ্চ বলা হয়, কিন্তু অন্য ধর্মের ঈশ্বরকে সেই সত্তার অসম্পূর্ণ প্রকাশ বলে মনে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্য ধর্মের ঈশ্বর যীশুর মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়। হিন্দুত্বের কিছু শাখায় (যেমন বিশিষ্টাদ্বৈত) অন্য ধর্মের দেবতাকে বিষ্ণুর অবতার বা প্রকাশ বলে দেখা হয়।

প্লুরালিজম (একই সত্তা): এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিভিন্ন ধর্মের ঈশ্বর একই সত্তার ভিন্ন প্রকাশ। জন হিকের মতো দার্শনিকরা যুক্তি দেন যে "দ্য রিয়েল" (সত্য সত্তা) বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন নামে (যেমন আল্লাহ, যিহোবা, ব্রহ্ম) প্রকাশিত হয়। হিন্দুত্বে, বিশেষ করে অদ্বৈতবাদে (যা আপনি উল্লেখ করেছেন), ব্রহ্ম সকল ধর্মের মূলে, এবং দেবতা (যেমন বিষ্ণু, শিব) তারই ভিন্ন রূপ। রিগ্বেদে (১.১৬৪.৪৬) বলা হয় "একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি" (সত্য এক, কিন্তু জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকেন)। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক লিবারেল থিওলজিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত, যারা বলেন যে সকল ধর্ম একই ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়।

ভগবান কেন কেবলমাত্র বিশ্বাসীদেরই সাহায্য করেন বলে মনে হয়?

যদি তাই হতো ,নাস্তিক না খেয়ে মারা যেতো। ভগবান কেবলমাত্র বিশ্বাসীদেরই সাহায্য করেন এমন কথা হিন্দু ধর্মের নেই। 

কর্মফল তত্ত্ব কেন নির্দোষ শিশুদের কষ্টের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়?

শঙ্করাচার্য, রামানুজ, বিবেকানন্দ—সকলেই স্বীকার করেছেন যে ব্যবহারিক স্তরে কর্মফল কাজ করে, কিন্তু পরমার্থিক স্তরে কর্মফল কাজ করে না। বাস্তবে কষ্টের কারণ পাপ নয়। কষ্টের কারণ হলো কর্ম। যেভাবে ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মে পাপের কারণ হিসেবে আদম ও ইভের সেই জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার ফল হিসেবে সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্মে সেরকম কোনো ধারণা নেই। 

"জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য"। যে শিশু কষ্ট পাচ্ছে সেটি আপাত সত্য। স্বপ্নে যখন সন্তান মরে যায়, জেগে উঠে কষ্ট হয় না। একইভাবে, আত্মজ্ঞান হলে জগতের সমস্ত কষ্ট মিথ্যা প্রতিভাত হয়।

বিবেকানন্দ বলেছিলেন: "কর্মফল ব্যাখ্যা করে ব্যবহারিক স্তরে। যে প্রশ্ন করে সেও মায়ায় আছে। জ্ঞান হলে প্রশ্ন থাকে না।"

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds