কুরআনের বিগ ব্যাং: বিজ্ঞানের পূর্বাভাস নাকি অতি-ব্যাখ্যার শিকার?


ভূমিকা

গত তিন দশক ধরে মুসলিম দাঈ ও জনপ্রিয় লেখকদের কাছে সূরা আম্বিয়া-৩০ সবচেয়ে প্রিয় “বৈজ্ঞানিক আয়াত”।

“কাফেররা কি দেখে না যে, আসমানসমূহ ও যমীন উভয়ই ছিল রত্ক (একত্রে সংযুক্ত), অতঃপর আমি উভয়কে ফাতাকনা (পৃথক করে দিয়েছি)?”



এই আয়াতকে তারা সরাসরি বিগব্যাং তত্ত্বের প্রমাণ বলে দাবি করেন। কিন্তু যখন আমরা নিরপেক্ষভাবে টেক্সট, তাফসীর ও আধুনিক কসমোলজির সাথে মিলিয়ে দেখি, তখন ছবিটা এত সরল মনে হয় না। বিগব্যাং ও শুধু আসমান জমিনের আলাদা করার বিষয় নয়।  বিগব্যাং এর  সময় সময়, স্থান ও শক্তির বিস্তার হয়েছিলো। সিঙ্গুলারিটি থেকে মাল্টি  এলিমেন্ট তৈরী হয়েছিলো।  তাই কোরআনের এই পর্যবেক্ষণ বৈজ্ঞানিক নয়, গজামিল । প্রথম ৩৮০,০০০ বছর পর্যন্ত আলো ও বস্তু পৃথক হয়নি, তারপর CMB (Cosmic Microwave Background) । হালকা এলিমেন্ট (হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম) বিগব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিসে (Big Bang Nucleosynthesis) তৈরি হয় প্রথম কয়েক মিনিটে।

বিগ ব্যাং কি “চূড়ান্ত সত্য”?

না। বিজ্ঞানে কোনো তত্ত্বই চিরকালের জন্য “এক্সাক্টলি সত্য” থাকে না।

  • বিগ ব্যাং মডেল (ΛCDM) আজ পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো ফিট করে পর্যবেক্ষণের সাথে (CMB, redshift, হালকা এলিমেন্টের পরিমাণ, গ্যালাক্সি ফর্মেশন ইত্যাদি)।
  • কিন্তু এরও অনেক সমস্যা আছে:
    • সিঙ্গুলারিটি (t=0) ব্যাখ্যা করতে পারে না (কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি লাগে)
    • ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি কী তা জানা নেই (মোট এনার্জির ৯৫%)
    • হরাইজন প্রবলেম, ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম → ইনফ্লেশন দিয়ে প্যাচ করা হয়েছে
    • JWST-এর নতুন ডেটা (২০২৩-২৫) দেখাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি বড় গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে, যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সাথে সহজে মেলে না।

১. আয়াতের প্রকৃত অর্থ কী ছিল সপ্তম শতাব্দীতে?

তাফসীরগুলো (তাবারি, কুরতুবি, ইবনে কাসির, জালালাইন) একবাক্যে বলেন:

  • আরবের মুশরিকরা বিশ্বাস করত আসমান ও যমীন সবসময় আলাদা ছিল এবং আলাদাভাবে সৃষ্ট।
  • কুরআন তাদের সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলছে: না, একসময় তারা জোড়া লাগানো (রত্ক) ছিল, তারপর আল্লাহ তাদের আলাদা করেছেন।

কোনো মুফাসসিরই এখানে বিগ ব্যাং, সিঙ্গুলারিটি, প্ল্যাংক টাইম বা প্লাজমা স্যুপের কথা বলেননি। তারা বলেছেন: আসমান ছিল যমীনের সাথে লেগে, তারপর আল্লাহ আসমানকে উপরে তুলে দিয়েছেন (যেমন ৪১:১১-এ “স্তম্ব ছাড়া উঠিয়েছি”) । এটা ছিল সপ্তম শতাব্দীর কসমোলজিক্যাল বিতর্কের জবাব, আধুনিক বিজ্ঞানের পূর্বাভাস নয়।

২. বিগ ব্যাং-এর সাথে টাইমলাইনের অসঙ্গতি

ঘটনাবিগ ব্যাং অনুযায়ী সময়কুরআনে ক্রম (৭৯:২৭-৩৩, ৪১:৯-১২)
আসমান-যমীন একত্রে (রত্ক)t = 0 থেকে ~৩৮০,০০০ বছরপ্রথম অবস্থা
আসমান ও যমীন পৃথক (ফাত্ক)কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্ত নেইআসমানকে ধোঁয়া থেকে → তারপর যমীন
যমীন গঠন~৯.২ বিলিয়ন বছর পরআসমানের পর (৭৯:৩০ “তারপর যমীনকে বিছালাম”)
নক্ষত্র ও সূর্যপ্রথম প্রজন্ম ~১০০ মিলিয়ন বছর পরযমীনের পর (৭৯:৩১-৩৩)

৩. “রত্ক” ও “ফাত্ক” শব্দের ভাষাগত অর্থ

আরবি ভাষায়:

  • রত্ক = সেলাই করা, জোড়া লাগানো, একসাথে বন্ধ থাকা
  • ফাত্ক = ছিঁড়ে আলাদা করা, খোলা, ফাঁক করা

এটা বিগ ব্যাং-এর “expansion from singularity” এর চেয়ে অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ প্রাচীন মিথের সাথে:

  • বাইবেল (জেনেসিস): আকাশ ও পৃথিবী একসাথে ছিল, ঈশ্বর তাদের আলাদা করলেন
  • মিশরীয় মিথ: শু ও তেফনুত (আকাশ ও পৃথিবী) আলাদা করা হয়েছিল
  • বাবিলনীয় এনুমা এলিশ: মার্দুক তিয়ামাতের দেহ দুভাগ করে আকাশ ও পৃথিবী বানালেন

৪. বিজ্ঞানের অস্থায়ী প্রকৃতি ও ধর্মগ্রন্থের সমস্যা

বিগ ব্যাং আজ সবচেয়ে ভালো মডেল, কিন্তু এটা চূড়ান্ত নয়। JWST-এর সাম্প্রতিক ডেটা (২০২৩-২৫) ইতিমধ্যে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে ফাটল ধরিয়েছে। কাল যদি বিগ ব্যাং মডেল পরিত্যক্ত হয়, তাহলে যে লাখো মানুষকে “কুরআন বিগ ব্যাং বলেছে” বলে ইসলামে আনা হয়েছে, তাদের কাছে কুরআন মিথ্যা প্রমাণিত হবে। এটাই হলো ধর্মগ্রন্থকে বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বানানোর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

বিগ ব্যাং-এর মূল উপাদানগুলো (যা আধুনিক বিজ্ঞান বলে)

  1. সময়, স্থান, বস্তু ও শক্তি সবই একটি সিঙ্গুলারিটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
  2. সিঙ্গুলারিটির পর প্রথম মুহূর্তে কোনো আলাদা “আসমান” বা “যমীন” ছিল না; সবকিছু একই প্লাজমা-স্যুপে মিশে ছিল।
  3. প্রথম ৩৮০,০০০ বছর পর্যন্ত আলো ও বস্তু পৃথক হয়নি, তারপর CMB (Cosmic Microwave Background)।
  4. হালকা এলিমেন্ট (হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম) বিগ ব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিসে (Big Bang Nucleosynthesis) তৈরি হয় প্রথম কয়েক মিনিটে।

কুরআনের আয়াতগুলো কী বলে? (২১:৩০ সহ অন্যান্য)

  • ২১:৩০ → “আসমান ও যমীন ছিল রত্ক (একসাথে জোড়া/সংযুক্ত), অতঃপর আমি তাদের ফাতাকনা (পৃথক করে দিয়েছি)”।
  • ৪১:১১ → “তারপর তিনি আসমানের দিকে মনোযোগ দিলেন যখন তা ছিল ধোঁয়া (দুখান)…”
  • ৭৯:২৭-৩০ → আসমান সৃষ্টির পর যমীনকে “বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে” (দাহা)।

উপসংহার

২১:৩০ আয়াতটি সপ্তম শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী রেটোরিক্যাল যুক্তি ছিল। এটি বলছিল: তোমাদের পৌত্তলিক কসমোলজি ভুল, আসমান-যমীন একসময় একত্রে ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে এর একটা আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য আছে, কিন্তু এটা বিগ ব্যাং-এর বৈজ্ঞানিক বর্ণনা নয়। এটাকে জোর করে বিগ ব্যাং-এর প্রমাণ বানানোর ফলে দুটো জিনিস ঝুঁকিতে পড়ে:
  1. যদি আগামীতে বিগব্যাং ভুল প্রমাণিত হয় তখন কুরআনের মর্যাদা কমে যাবে। 

কুরআনকে তার নিজস্ব শক্তিতে রাখুন: আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক পথনির্দেশক হিসেবে। তাকে জোর করে বিজ্ঞানের বই বানালে, যেদিন ১৯৭৬-এ মরিস বুকাইলি যা শুরু করেছিলেন, তা একদিন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds