শয়তান যদি স্রষ্টা হতো, তবে জগতটি সম্ভবত প্রলোভন, বিশৃঙ্খলা, এবং কঠোর আনুগত্যের দাবির উপর নির্ভর করত। শয়তানের জগত হয়তো তার অহংকার ও সম্মানের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত, যেখানে মানুষের স্বাধীনতা বা আধ্যাত্মিক উন্নতির পরিবর্তে প্রলোভন ও পরীক্ষা প্রাধান্য পেত।
উদাহরণ স্বরূপ, “রাস্তায় টেনে আনা হলো, মুনাফিকদের। ওদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা, ওদের যারা টেনে আনলো, তাদেরও মুখ একরকম কালো মাস্ক দিয়ে ঢাকা। এরপর মুনাফিকদের লাইন করে বসানো হলো। চারিদিকে মোবাইলের ক্যামেরা খুলে চিৎকার, “সেই স্রষ্টা সব থেকে মহান। স্রষ্টা সব থেকে বড়।” তারপর গর্জে উঠলো বন্দুকের শব্দ। চিৎকার থেমে গেল, মুনাফিকের নিথর দেহ পড়ে রইলো। রক্তে ভিজে গেল মাটি। হাউ মাউ করে কাদতেঁ শুরু করলো মুনাফিকের স্ত্রী ও সন্তানরা।
তাও, তাদেরও নিস্তার নেই মুনাফিকের স্ত্রী ও সন্তানকে আলাদা করে জড়ো করা হলো একটি বাজারে। ওখানে ওদের টাকার বিনিময়ে কৃতদাসী ও কৃতদাস হিসেবে বিক্রি করা হবে।
আজ এই এসব গল্প মনে হলেও, পাশ্চাত্যের দেশগুলো তে এভাবেই মানুষ বেচা কেনা হতো। এটাই ছিল পাশ্চাত্যের ধর্মের স্বরূপ। আজ তারা মানবতার কথা বলে, নারী অধিকারের কথা বলে, কিন্তু একটা সময় এগুলো তাদের ধর্মীয় সিদ্ধান্তের বিপরীত ছিলো।
মানুষ যখন মুনাফিক ভেবে মানুষ কতল করে, পরমেশ্বর কি খুশী হয়?
হিন্দু, ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী আমরা সবাই জানি ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন নিজেকেই ব্যাক্ত করতে। এই জগত তাঁর ঐশ্বর্য্য। তাই জগতের কোনো প্রাণী কষ্ট ভোগ করলে তিনিই তাহা অনুভব করেন। এই জন্য তিনি চেতনময়।
তাহলে যখন কোনো কষ্ট ভোগ করে, তিনি কেন তার কষ্ট দূর করার জন্য আসেন না।
ইশ্বর কেন প্রকট হন না?
জগৎ সংসারে দুঃখ কষ্ট কেন?
“আছে যত যার, চাই আরো তাঁর।চাওয়ার নাই কোনো অন্ত।সবচেয়ে সুখী সেই,যার কোনো দায় নেই,যিনি জেনেছেন অনাদি অনন্ত।”
সুখ বা দুঃখের বিষয় পাশ্চাত্য ঈশ্বরবাদ বলেন, মানুষের আদি মাতা ও পিতা ইভ ও আদম, ঈশ্বরের কথা উপেক্ষা করে ইডেন গার্ডেনের নিষিদ্ধ ফল খেয়েছেন। যার ফলে সংসারে এই সুখ দুঃখের প্রভাব দেখা যায়। এর পেছনে শয়তানের হাত আছে। অর্থাৎ, যা কিছু ভালো, সেই সব ঈশ্বরের কিন্তু যা কিছু মন্দ, সে সবের পেছনে ঈশ্বর দায়ী নয়।
আমরা সনাতনীরা বলছি, ভালো বা মন্দ কোনো কিছুই ঈশ্বরের দায় নয়। ভালো বা মন্দ আমাদের কর্মের ফল ও বিবেকের ওপর নির্ভশীল। তাহলে ঈশ্বর কোথায়? তাঁর প্রয়োজনীতা কি?
ইশ্বর আমাদের আত্ম পরিচয়।
ঈশ্বর আমাদের আত্ম স্বরূপ। হিন্দু অদ্বৈত বলছে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। স্বজাতীয় ভেদ শূন্য, বিজাতীয় ভেদ শূন্য এবং সগত ভেদ শূন্য। অর্থাৎ, মানুষের মতো মানুষ আছে, গোরুর মতো গরু আছে, কিন্তু পরমেশ্বরের মতো দ্বিতীয় কোনো পরমেশ্বরের নেই, এটা ইসলামের তাওহীদ বা আব্রাহামের ইয়াহ্বা পরমেশ্বরের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু, ইশ্বর কেবল স্বজাতীয় ভেদ শূন্য নয়, তিনি বিজাতীয় ভেদ শূন্য, অর্থাৎ ঈশ্বর ব্যতীত কিছুই নেই। যেমন, মানুষ ও গরু, গরু ও মোবাইল, এরকম আলাদ আলাদা জাতীয় ভেদ ইশ্বরের নেই। তাই, ইশ্বর জগৎ আলাদা আলাদা নয়।
এই চিন্তা আব্রাহামিক ধর্মমত গুলোতে নেই। সেখানে ইশ্বর ও জগত দুটি আলাদ আলাদা বস্তু। এমনকি ইশ্বরের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। শয়তান বা দজ্জাল, এরকম কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। কারণ, দ্বন্দ্ব অসদ বস্তু। ইশ্বর অসদ বস্তু নয় তাই তিনি
এরপর হলো সগত ভেদ। ইশ্বরকে অনাদি অনন্ত বলা হয়। অর্থাৎ, শুরু ও শেষ নেই। খ্রীষ্টান ধর্মে বলা হয় তিনিই আলফা (α), অর্থাৎ আরম্ভ এবং ওমেগা (Ω) অর্থাৎ অন্ত। তিনি পবিত্র, আমাদের ঈশ্বরের কাছে পবিত্র বলেও কিছু নেই।
পবিত্র অপবিত্র বা সর্ববস্থা গতঃপিবা,য়ৎ স্মরেৎ পুন্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তর শুচিঃ।
পবিত্র অথবা অপবিত্র অবস্থায় যিনি পুন্ডরীকাক্ষ অর্থাৎ শ্রী বিষ্ণুকে স্মরণ করেন, তাঁর বাহ্য এবং অভ্যন্তর শুচি হয়ে যায়।
বহু দেবী-দেবতা কি?
হিন্দু ঈশ্বর যদি ভেদ শূন্যই হন, তবে এত দেবী-দেবতা কেন? দেবী দেবতারা হলেন পরমেশ্বরের মায়াধীন আমাদের মতোই এক প্রকার সত্তা।
বহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ থেকে আরম্ভ করে ইন্দ্র, অগ্নী, যম, কুবের এরা সবাই পরমেশ্বরেরই ব্যক্ত সত্তা। কাজেই এরা অব্যক্ত পরমেশ্বরের ব্যক্তরূপ।
যেমন ক খ গ ঘ বর্ণ গুলি বাগ যন্ত্রের উচ্চারিত ব্যক্ত রূপ। সেভাবে বিভিন্ন দেবী দেবতারা ঈশ্বরের ঐশ্বর্যের ব্যক্ত রূপ। যাদের কাজ হলো জগত পরিচালনায় সহযোগিতা করা। এরা সবাই মূলে অভিন্ন।
সর্ব শক্তিমান, তাঁর কি সহযোগী কেন প্রয়োজন ?
পরমেশ্বর সর্ব শক্তিমান — এতে কোনো দ্বিমত নেই। যখন আমরা বলি “সর্ব শক্তিমান” তখন আমরা কোন শক্তির কথা বলি? শক্তি কি শুধুই বাহুবল? শক্তি বলতে আমরা সামর্থ্যকেও বুঝি। আমাদের বলা, চলা, আহার সব কিছুই সেই সর্ব শক্তিমানের শক্তিরই অংশ।
যেমন, রাজা সামর্থ্যবান, তিনি সকলের অন্ন দাতা। তাই বলে রাজা তো দাড়িপাল্লা নিয়ে বাজারে বসেন না, বা নিজে হাতে মৃত্যু দন্ড দেন না। তিনি আদেশ দেন, তাঁর হয়ে তাঁর প্রতিনিধি করেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে রাজা একাই যুদ্ধ করেন না। রাজার সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে। সেনাবাহিনী তাঁর শক্তি।
তাই, এটা একটি সম্পূর্ন ভুল ধারনা যে ঈশ্বরের সহযোগীর প্রয়োজনও নেই। ঈশ্বরের সহযোগী না থাকলে গ্যাব্রিয়েল বা জিবরাইল কে ছিলেন? যিশুর জন্মের সময় ঈশ্বরের দূত গ্যাব্রিয়েলকে পাঠানো হয়েছিল, নবী মুহাম্মদের কাছে সেই গ্যাব্রিয়েল বা জিবরাইলই কোরআন নিয়ে এসেছিল। এছাড়া নবী এবং বিভিন্ন ভবিষ্যত বক্তাদের উপযোগীতা কি?
সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছায় যখন জগতের এতো কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, তাই নয় কি?
তাই, হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেবী দেবতারা তারই প্রকাশিত সাকার রূপ , এরা তাঁরই শক্তিতে চালিত।ঈশ্বর কোনো শর্ত সাপেক্ষে নয়।
প্রকৃত ধর্মের প্রকৃত ঈশ্বর সবার জন্য সমান
মুনাফিক, নাস্তিক, অস্তিক, কোনো কিছুই তাঁর অপছন্দের নয়। কারণ তিনিই তো এদের সৃষ্টি করেছেন।
কিন্তু, আল্লাহ বা গড জগত সৃষ্টি করেছেন মানুষের ইবাদত গ্রহণ করতে। আর, তাঁর নাফরমানী করলেই মানুষের দুর্গতি।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বলছে, ঈশ্বরের ভক্তি করার বিভিন্ন বিধি আছে বটে, সব বিধিতেও তিনিই পূজিত হন। তাই কোনো রকম বাধা নেই। সকল উপাসনা পদ্ধতিতে ঈশ্বরের কৃপা পাওয়া যায়। এমনকি উপাসনা না করেও শুভ কর্মের দ্বারাই ঈশ্বরের কৃপা লাভ হয়।
অন্য দিকে আল্লাহ বা ইয়াহবা বলছেন, “আমায় ছাড়া অন্য কোনো উপাসনা করবে না। করলে নরকের আগুণ তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
একবার ভেবে দেখুন, যদি শয়তান স্রষ্টা হত তবে এই জগত কেমন হতো?
সুনাম শুনে দেবতা খুশি হয়, শয়তান কি নিজের জন্য অসন্মান চাইবে? না, শয়তানও সন্মান চাইবে। ইসলামিক কাহিনী অনুসারে, ইলবিস্ জিন আল্লাহের নাফরমানী করে শয়তান হয়েছে।
আল্লাহ মাটি থেকে আদমকে ও তাঁর স্ত্রী হবা (ইভি)সৃষ্টি করে। তারপর পরমেশ্বর আদমকে সব কিছু শিখিয়ে ফরিশতাদের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে আল্লাহ সকল ফরিস্তাদের আদমকে সেজদা করতে বললেন। সবাই সেজদা করলো, কিন্তু ইবলিস বলে এক জিন সেজদা করেনি। আল্লাহর নাফরমানী কুফর। তাই, আল্লাহ ইবলীসকে স্বর্গ থেকে বের করে দিলেন। সেই বিতাড়িত ইলবিসই হলো শয়তান।
সেই, ইবলিস আল্লাহর ইচ্ছাতেই মানুষকে ঘৃণা করে। মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে বিপথগামী করে। ইলবিস আল্লাহ বিরোধি নয়। সেও আল্লাহর ইবাদত করে, তার কাজ হলো মানুষকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে, আল্লাহর প্রতি ঈমান পরিক্ষা করা
একই গল্প আছে খ্রিষ্টানদের বাইবেলেও। তবে সেখানে গল্পের ভঙ্গিমা কোরআন থেকে আলাদা। খ্রীষ্টান শয়তান ঈশ্বরের সরাসরি শত্রু। যাকে মাঝে মাঝে ডেভিল বা দিয়াবল (Diabolos / Devil) বলা হয়। ডেভিল হলো অপ দেবতা “διάβολος”। এর অর্থ এসেছে ক্রিয়া পদ διαβάλλειν (diabállein) থেকে,যার মানে — “বিরোধিতা করা, আলাদা করে দেওয়া, বা দোষ চাপানো।” এই দিয়াবল বা Devil এসেছে জরথুস্ত্রবাদ (Zoroastrianism)-এর দেইবা (Daeva) ও আহুরা (Ahura)-দের গল্প থেকে। দেইবারা ডেভিল হয়ে গেছে।
এই কনসেপ্ট হিন্দুদের দেব ও অসুরের গল্পের উল্টো রূপ। যেখানে অসুর গুলো ভলো, আর দেবতার অন্ধকার জগতে বাস করে।
দেবতা ইন্দ্র, অগ্নী এদের বেদে অসুর বলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অসুর ও দেবতাদের ইর্ষা জনিত কারণে বিভেদ হয়ে যায়।
জরথুস্ত্রবাদী দের গল্পে আহুর বা অসুররা অগ্নী পূজা করেন, তারা আগুনকে পবিত্র মনে করেন, আহুরা মাজদা অর্থাৎ অসুর মহান তিনি আলো সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করলে আঙ্গীরা মুনি বা অঙ্গীরা মাইনু ঈর্ষা করে নিজের সেনা ‘দেইব’ বা দেবতাদের দ্বারা অসুর সংস্কৃতিতে আক্রমণ করে।
এই দেইবরা হলেন অহুরার বিরোধী। পরবর্তী সংস্কৃতিতে এই দেইব ডেভিল হয়ে গেছে।
হিন্দু গল্পে আসুররা মুনি ঋষিদের যজ্ঞ ও ধ্যানে নানা বাঁধা সৃষ্টি করতো। হত্যা লুঠ ও নানা অত্যাচার করতো। দেবতদের স্বর্গ এবং অসুরদের পাতালে স্থান দেওয়া হলো। এভাবেই অসুর ও দেবতা আলাদা দুটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
এই দেবতার ওদের কাছে ডেভিল। ওদের আহুরা আমাদের কাছে অসুর।
ইসলামের শয়তানের সঙ্গে ইয়াজিদিদের মেলেখ তাউস এর সঙ্গেও মিলে যায়। কিন্তু, সেই গল্পেও পরিবর্তন করা হয়েছে।
অর্থাৎ, এক সংষ্কৃতির দেবতা অন্য সংষ্কৃতিতে গিয় শয়তান বা অপদেবতা হয়ে গেছে। পরমেশ্বর সকল ফরিস্তাদের আদমকে সেজদা করতে বললেন। সবাই সেজদা করলো, কিন্তু মেলেখ তাউস করলো না। পরমেশ্বর এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। মেলখ তাউস বললেন, “ আপনি আমার স্রষ্টা, আমি কেবল আপনার সেজদা করি।”
পরমেশ্বরখুশি হয়ে ইয়াজিদি দের প্রধান দেবতা নিযুক্ত করলেন। ঈশ্বর তাকে পুরস্কৃত করেন, কারণ তার সেই অবাধ্যতা ছিল ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠতা ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন