চন্দ্রগ্রহণে কুসংস্কারের ছায়া, নাকি বিজ্ঞানচেতনার অভাব?

চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে প্রতিটি পৃথিবী জুড়ে হাজারো মান্যতা আছে। কিন্তু ভারতের সংস্কার গুলোকে কুসংস্কার হিসেবে দেখানো হয়। যদি আপনি আধ্যাত্মিক দৃষ্টি কোণে দেখেন, তবে হিন্দু পদ্ধতিকে পৈশাচিক বলা হয়, আর যদি নাস্তিক দৃষ্টিতে দেখেন, তবে অন্ধ বিশ্বাস বলে ছোটো করা হয়।

শাস্ত্র আমাদের সংস্কার শেখায়। সকল কু-সংস্কার অ-শাস্ত্রীয়। অর্থাৎ, শাস্ত্র দ্বারা প্রদর্শিত নয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মের নামে মানুষ নানা কাজকর্ম করেন, যার কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই। এগুলোকেই কুসংস্কার বলা হয়। আজ আমরা চন্দ্রগ্রহণে কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা করবো।

আসলে চন্দ্র গ্রহন কি?

অধুনিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ হিসেবে একই সরলরেখায় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে আসে, তখন পৃথিবীর ছায়া চাঁদের ওপর পড়ে। ওই সময় সূর্যের আলো চাঁদে পৌঁছায় না, ফলে চাঁদকে তখন কিছু সময়, ধিরে ধিরে কমতে দেখা যায়। একে চন্দ্র গ্রহন বলা হয়।

অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দর্শকের কাছে চাঁদের আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা চন্দ্র গ্রহণ। 

প্রতিদিন কেন চন্দ্রগ্রহণ হয় না?

অধুনিক বিজ্ঞানের বহু আগে আমাদের দেশের বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ও পুরান শাস্ত্রে রাহু ও কেতু বলে দুই রাক্ষসের গল্প বলে গেছে। যা সমুদ্র মন্থন, অমৃত কুম্ভ এবং দেবাসুর সংগ্রামের ইতি কথা আছে। 

সংক্ষেপে অমৃত কুম্ভ নিয়ে যখন শ্রী হরি বিষ্ণু দেবতা ও অসুরদের মধ্যে বিতরণ করছিলেন। সেই সময় তিনি ছল করে অসুরদের মদিরা এবং দেবতাদের অমৃত সুধা দিচ্ছিলেন। বিষ্ণুর এই ছলনা  স্বর্ভানু নামক এক অসুর ধরে ফেলে। সে দেবতা সেজে দেবতাদের মাঝে গিয়ে বসে অমৃত পান করে। সেই সময় সূর্যদেব ও চন্দ্রদেব তাকে ধরিয়ে দেয় এবং বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে স্বর্ভানুর গলা কেটে দেয়। ততক্ষণে, সেও অমৃত পান করে অমর হয়ে যায়। তাঁর খন্ডিত দেহ রাহু ও কেতু নামে পরিচিত।

এই কেতু এবং রাহু হলো জ্যোতিষ শাস্ত্রে দুটি ছায়া গৃহ অর্থাৎ অদৃশ্য বিন্দু। যা অক্ষ রেখার অবস্থান দ্বারা নির্নয় করা হয়েছে। 

চাঁদের কক্ষ পথকে চন্দ্র মন্ডল, এবং সূর্যের কক্ষপথকে সূর্য মন্ডল বলে। এই দুই কক্ষ পথ পরস্পর পরস্পরকে ৫ ডিগ্রী কোণে ছেদ করে। অর্থাৎ চাঁদের কক্ষপথ একটু হেলানো অবস্থায় সূর্যের কক্ষপথ কে ৫° কোণে ভেদ করে। যেই  দুই বিন্দুতে চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথকে ছেদ করে, সেই দুটি বিন্দুই হলো রাহু ও কেতু। 

গ্রহ বললেও এগুলো বাস্তবে কোনো গ্রহ নয়। অধিকার বা গ্রহন করে আছে বলে এদের গ্রহ বলা হয়েছে।

তাই, প্রতিদিন পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় আসেনা। তাই চাঁদ, রাহু ও কেতু স্পর্শ করেনা। চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্যের তল থেকে নিচে বা ওপরে থাকে। অবস্থান করে 

বৈদিক বিজ্ঞান:

পাশ্চাত্য দেশ ও আমাদের দেশের বামপন্থী মানসিকতার লোক গুলো বেদকে খুব হালকা ভাবে নিতো। কিন্তু বর্তমানে তাদের সেই ভুল ধারণা গুলো দিন দিন কমে যাচ্ছে। 

বেদে বিজ্ঞান আছে এই বক্তব্য আমার করছি না। বেদ নিজেই এর প্রমাণ দিচ্ছে। আর্যভট্ট তাঁর সূর্য সিদ্ধান্ত বইয়ে বেদের সূর্য দেবকে দেবতা হিসেবেই দেখছেন। প্রথমেই তিনি সূর্য দেবকে প্রণাম করে, বৈদুক সিদ্ধান্ত দ্বারাই সূর্য সিদ্ধান্ত লিখেছেন। বেদের দেবতা, নক্ষত্র, যোগ ও তিথির কথা উল্লেখ করেছেন।

সেখানে তিনি নক্ষত্র, রাশি, ঋতু পরিবর্তন, মাস গণনা কিভাবে করতে হয় তা বলেছেন। অর্থাৎ চন্দ্রের সঙ্গে নক্ষত্রদের বিবাহ, রাহু কেতু এসব আসলে কি, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দু উপহাস:

যখনই সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ হয়। তখন কিছু কিচ্ছু লোক এই ধরনের পোস্ট করে। এইরকম একটা পোস্ট

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একবার আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র বলেছিলেন— "আমি ক্লাসে ছাত্রদের শেখালাম যে, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়লে চন্দ্রগ্রহণ ঘটে। তারা তা লিখল, শিখল, পরীক্ষায় নম্বর পেল, পাশ করল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যখন সত্যিই চন্দ্রগ্রহণ হল, তখন তারা রাস্তায় বেরিয়ে ঢাক-ঢোল, করতাল, শঙ্খ নিয়ে বলতে লাগল রাহু চাঁদকে গ্রাস করেছে। এ এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ!”  

চন্দ্র গ্রহণ বা সূর্য গ্রহণ রাহু গ্রাস করছে এটা তো ঠিক। কিন্তু ভারতের কোথাও  ঢাক-ঢোল, করতাল, শঙ্খ বাজিয়ে বলে বেড়ায় না রাহু চাঁদকে গ্রাস করেছে। এমন ঘটনা আমার চোখে পড়েনি। এই  ঢাক-ঢোল, ভেড়ি বাজিয়ে  পশ্চিমী সংস্কৃতির Norse এবং Viking রা গ্রহণের শেয়াল রাক্ষসকে দূর করতো। 

Norse এবং Viking এরাও যে একেবারেই গৃহ নক্ষত্রের হিসেব জানতো না, এমনটা নয়। মিশর, রোম, সব দেশেই গণনার নিজ নিজ পদ্ধতি ছিলো। 

তন্ত্র শাস্ত্রগুলোতে  বলা হয়েছে এই  দিন জপ করলে মন্ত্র পুনঃশ্চরণ বা মন্ত্র সিদ্ধি হয়। তাই, ভারতীয়রা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্য্য গ্রহণের দিনকে একটি আধ্যাত্মিক উন্নতির ঘটনা মনে করে।  এই দিন ওই সময় কোনো প্রকার খাদ্য বা পানীয় খেতে নেই। কারণ মনে করা হয়, যেহেতু রাহু গ্রাস করছে তাই, আহার করলে তামসিক বুদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের জন্য কোনো কিছু নিষেধ নাই। অর্থাৎ, এটি অতি আবশ্যক কোনো প্রথা বা কুসংস্কার নয়। তাও, কেন উপহাস করে কে জানে?

ফলিত জ্যোতিষ ও অপপ্রচার?

রামায়ণ মহাভারতের আমরা যে সকল মহান ঋষিদের কথা পাই, তারাও জ্যোতিষ জ্ঞান রাখতেন। রামের রাজ্যভীষেকের সময় গণনা করা হয়েছিলো কিন্তু রাজা দশরথ তোয়াক্কা না করেই তাড়াহুড়ো করে। ফলে রাম রাজা না হয়ে বনবাসী হয়। কিন্তু যিনি ভগবানের অবতার, যার ইচ্ছায় গৃহ নক্ষত্রের দিশা পরিবর্তন হয়। তিনি কেন নিজের ভাগ্য বদলে দিলেন না?

এখানেই ফলিত জ্যোতিষের মুখোশ খুলে যায়। জ্যোতিষ কেবল মঙ্গল অমঙ্গল বলতে পারে, কারণ এগুলো এক প্রকার Statistics বা পরিসংখ্যান গত তথ্যের ভিত্তিতে হয়। তাই, অমঙ্গল কিভাবে হবে, সেটা কেউ বলতে পারে না।সেখানে আসে অনুমান বা সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা বা probability। এই অনুমান বা সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ফলিত জ্যোতিষ শাস্ত্রীরা অনেক টোটকা দিয়ে থাকেন এগুলোই ঠগবাজী।

আসলে এই টনা-টোটকা গুলো তন্ত্রের কাজ। পাথর, শিকড়, যন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রের কাজ। কিন্তু যখন তন্ত্রের টনা-টোটকা দেখিয়ে কেউ বলে আমি গ্রহ ঠিক করে দেবো। বুঝতে হবে, ব্যাটা ভন্ড। শ্রী রাম পারলো না। শ্রী কৃষ্ণ পারলো না। তুমি পারবে?

যা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হচ্ছে। যা হবে তাঁর ইচ্ছাতেই হবে। যদি নিজের ইচ্ছা খাটাতে যাই, তবে দায় দোষ নিজেকেই নিতে হবে। আর অসীম ব্রহ্মাণ্ডের স্বামীর বিপক্ষে গিয়েও কি হবে? তিনিই তো শেষ গন্তব্য। যেটা আমার ইচ্ছা বলছি, সেটাও তো তাঁরই প্রেরণা। অমরা তো তাঁরই হাতের পুতুল।

উপসংহার

চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ প্রকৃতপক্ষে একটি বৈজ্ঞানিক মহাজাগতিক ঘটনা। পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের নির্দিষ্ট অবস্থানগত সম্পর্কের কারণে এ ধরনের ছায়া তৈরি হয় এবং আমাদের কাছে গ্রহণ দৃশ্যমান হয়। অথচ যুগে যুগে এই প্রাকৃতিক ঘটনাকে ঘিরে নানা পৌরাণিক কাহিনি, আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ও কুসংস্কার জন্ম নিয়েছে। শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাহু-কেতু আসলে নাক্ষত্রিক বিন্দু—গ্রহ নয়। তাই রাহু চাঁদকে খেয়ে ফেলে বা সূর্যকে গ্রাস করে—এটি প্রতীকী বর্ণনা, আক্ষরিক সত্য নয়।

ভারতের সমৃদ্ধ জ্যোতির্বিদ্যা—বেদ, সূর্যসিদ্ধান্ত, আর্যভট্ট বা বরাহমিহিরের মতো আচার্যদের গবেষণা—প্রমাণ করে আমাদের শাস্ত্র কখনোই অন্ধবিশ্বাস শেখায়নি, বরং বিজ্ঞানেরই পূর্বসূরি হয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রে গ্রহণকালকে আধ্যাত্মিক সাধনার বিশেষ সময় হিসেবে মানা হয়েছে, যা মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক।

অতএব, গ্রহণকে ঘিরে ঢাকঢোল বা অযৌক্তিক ভয়, নিষেধাজ্ঞা এগুলো প্রকৃত শাস্ত্রসম্মত নয়—এগুলো কেবল কুসংস্কার। গ্রহণের প্রকৃত শিক্ষা হলো—মানুষ যেন প্রকৃতির মহিমা উপলব্ধি করে, বিজ্ঞানকে সম্মান করে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিকে উপলক্ষ্যে গ্রহণ করে।

চন্দ্র গ্রহণ মানে ভয় নয়, বরং মহাজাগতিক সত্যকে জানা ও আত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করার সুযোগ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Advertisement