অজাচর নিয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদ আরোপ খন্ডন।


ভূমিকা:

সাহিত্যিক আব্দুল আজিজ আলআমানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হরফ প্রকাশনীর প্রকাশিত বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১ম  অধ্যায়ের ৪ র্থ  ব্ৰাহ্মণের ৩য় শ্লোক  অনুসারে, প্রজাপতি তার শরীর হতে এক নারীকে উৎপন্ন করে তার সাথে মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করেছিলেন। সেই উৎপন্ন স্ত্রীকে প্রজাপতির  কন্যা এবং প্রজাপতির কামনাকে অজাচার বলে চালানো হচ্ছে। ওই উৎপন্ন নারী প্রজাপতির কন্যা বা নিজ সন্তান কিনা সেটা একটা বিচার করার বিষয় বটে। তারপর, এটাও বিচার করতে হবে যে, এই উপনিষদ কি এরকম অজাচার প্রচার করেছেন? 

 দেখুন কি বলছে :

ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ : 

"(কিন্তু) তিনি আনন্দ পাইলেন না; সেইজন্য কেহ একা থাকিয়া আনন্দ পায় না।" কারন শ্রষ্ঠা প্রজাপতি নিজেও আদিতে একাকীত্ত্ব পছন্দ করেন নাই।  তাই তাঁর  ইচ্ছা হলো এক থেকে দুই হওয়ার। “তিনি দ্বিতীয় (সঙ্গী লাভ করিতে) চাহিলেন। ওই একাকীত্ত্ব অবস্থায় স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গিত হইলে যে পরিমাণ হয়, তিনি ততখানিই ছিলেন।” —অর্থাৎ ওই স্ত্রী ও পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন কোনো সত্ত্বা হিসেবে ছিলো না। এরপর তিনি নিজের দেহকে দুইভাগে ভাগ করিলেন। "এইভাবে পতি  ও পত্নী হইল।” —স্পষ্টতই উৎপন্ন নারী প্রজাপতির কন্যা নয়। অর্থাৎ, জগতের সৃষ্টি প্রবাহ চলনের উপাদান বিপরীত দুই লিঙ্গ সৃষ্টি হোলো।

এখানে কামনা বা ভগবৎ ইচ্ছা।  এই জন্য যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন- ‘প্রত্যেকে নিজে অর্ধবিদলের মত’; এই জন্য শূন্য স্থান স্ত্রী দ্বারা পূর্ণ হয়।’

তিনি সেই পত্নীতে মিথুনভাবে উপগত হইয়াছিলেন। তাহার ফলে মানুষের উৎপত্তি হইল। –দেখুন এখানেও "পত্নীতে" বলা হয়েছে। অর্থাৎ উৎপন্ন নারী কন্যা সন্তান নয়।

শব্দ ব্রহ্মের খেলা:

ওই প্রকাশনীর বইতে সরাসরি বিকৃত কিছু নেই, তবে অনুবাদ অতিরঞ্জিত। যে শব্দ নেই , সেই শব্দকে তুলে ধরে বিকৃত ভাব প্রস্তুত করা হয়েছে।  যার ফলে পাঠকের মনে সহজাত ভাবেই বিকৃত চিন্তা উদয় হয়। 

যার হৃদয়ে পূর্ব-কল্পিত বিকৃত ভাব আছে, সে নিন্দা করার জন্য শাস্ত্র থেকে বিকৃত ভাবকেই দেখবে। ভালো কিছুতেও দোষ দর্শন করবে। সম্ভবত সেই কারণেই, এই নাস্তিক ব্লগারদের সমালোচনাতে এরকম ভাব প্রকাশ পেয়েছে।

শব্দের প্রভাব

শব্দের মধ্যেও প্রভাব থাকে। তাই শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে করতে হয়। নইলে বক্তব্য স্পষ্ঠ হয় না। শব্দ অনেক শক্তিশালী একটি অস্ত্র।

উদাহরণ হিসেবে:

  • তুমি কিন্তু আমার বাড়ি আসবে, না আসলে আমি রাগ করবো।
  • তুমি কিন্তু আমার বাড়ি আসবে না, আসলে আমি রাগ করবো।
এখানে একটি কমা (,) সম্পূর্ণ অর্থ বদলে দিয়েছে।
আরেকটি উদাহরণ দেখুন:

  • তোমার বাবা কি একটা ছাগল?...” 
  •  “তোমার বাবা কি একটা ছাগল কিনেছেন”? 

এখানে অসম্পূর্ণ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রেক্ষাপট ছাড়া অসম্পূর্ণ বাক্য ভ্রান্তি সৃষ্টি করে।   

শব্দ প্রয়োগে সাবধাতনা

অনুবাদে সাবধানতা দরকার: 

  • Rahim and his Teacher Ayesha have a very good relationship.
  • Tamanna had a deep relationship with Rahim past two years.

এখানে Relationship শব্দটি অনুবাদ করার সময় খুবই সাবধানে ব্যাবহার করতে হবে। নইলে বিকৃত অর্থ হয়ে যাবে।

মোদ্দা কথা কি বলে? 

আপাত দৃষ্টিতে বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত অংশে অজাচার হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও এর গভীর তত্ত্ব সৃষ্টির আদি তত্ত্ব বর্ণনা করছে। সেই তত্ত্ব বুঝতে হলে সম্পূর্ণ শাস্ত্রকে শাস্ত্রের দৃষ্টিতেই পড়তে হবে। তাহলে প্রশ্ন করুন :

উপনিষদ কি? তাঁর  বিষয় বস্তু কি?  তা না জেনে কেবল মাত্র একটি শ্লোক তুলে হিন্দু সনাতন ধর্মীয় পুস্তককে অজাচার  সিদ্ধ করা যায় না।আসুন, প্রথমে জেনে নেই উপনিষদ কি?, এর উদ্দেশ্য কি? এবং এর শৈলী কি?

উপনিষদ কি?

উপনিষদ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে যে অর্থ প্রকাশ পায়, সেটি হলো — “শিষ্য গুরু-র কাছে বসে গোপন জ্ঞান শিখছে”। 

বেদের সার কথাকে উপনিষদ বলা হয়। অর্থাৎ উপনিষদ কোনো আকাশ থেকে আবির্ভূত হওয়া, বা কোনো এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর নাজিল  হওয়া পুস্তক সংস্করণ নয়। বা কোনো নির্দিষ্ট দেবতা বা পদ্ধতির Promotion নয়। 

এই উপনিষদ, হিন্দু পূর্বপুরুষ, অর্থাৎ যাদের আমরা ঋষি বলে থাকি। তাঁদের দ্বারা বেদ শাস্ত্রের জ্ঞান সংকলন। 

উপনিষদের উদ্দেশ্য কি এবং এর শৈলী কি?

উপনিষদের মূল বক্তব্য হলো ব্রহ্মের অখন্ড তত্ত্বের জ্ঞান অর্জন করা। 

যদি এর শৈলীর কথা বলি, তবে এটি কথোপকথন ও গল্পের ছলে জ্ঞান দানের ব্যবস্থা। যেখানে অব্যক্ত, অচিন্ত ভগবত তত্ত্বকে বিভিন্ন উপমা বা তুলনার দ্বারা ব্রহ্মের অখন্ড তত্ত্ব জ্ঞান প্রস্তুত করা হয়েছে।

কাম ও মৈথুন বিহীন সৃষ্টি

একবারে ভেবে দেখুন কেউ নিজের শরীর থেকে এক নারীকে উৎপন্ন করেছেন। এবং সেই নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কি পিতা ও পুত্রীর সম্পর্ক হবে?  পুত্র বা পুত্রী আমরা তাকেই  বলি যার উৎপত্তি মৈথুনের ফলে হয়। তখন তো মৈথুন ছিলোই না। উক্ত শ্লোক বলছে —"একাকীত্ত্ব অবস্থায় স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গিত হইলে যে পরিমাণ হয়, তিনি ততখানিই ছিলেন"  এর তাৎপর্য কি? 

এর তাৎপর্য এই যে, এই জগত এক এবং অদ্বিতীয় সত্ত্বা থেকে এসেছে। এক ভিন্ন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো সত্ত্বাই ছিল না। এবং আজও সেই এক সত্ত্বাই নারী ও পুরুষ রূপে অবস্থান করছে।

আজ  যা এসেছে, সে যেখান থেকে এসেছে, সেটি একই সত্ত্বার ভিন্ন প্রকাশ। নারী ও পুরুষের মিলন বা মৈথুন ছাড়া সৃষ্টির গতি সম্ভব নয়, "স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গিত" ছিলো তারপর নারী ও পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকট হলো।  নারীর প্রতি পুরুষের আসক্তি বা কামনা প্রকট হলো। 

প্রজাপতি তার শরীর হতে এক নারীকে উৎপন্ন করে তার সাথে মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করেছিলেন। 

অর্থাৎ, সৃষ্টির চালিকা শক্তি মৈথুন ক্রিয়ার উৎপত্তি সেই ঈশ্বরই প্রবর্তন করেছেন। যার ফলে, আমি আপনি আমরা সবাই জন্ম হয়েছি। "এইভাবে পতি  ও পত্নী হইল।" অর্থাৎ ওই নারী তাঁর  কন্যা ছিলেন না। কিন্তু , ওই নারী নিজেকে শত রূপে প্রকট করে প্রজাপতিকে বিভিন্ন সৃষ্টির কাজে নিযুক্ত করলেন।  তিনি  গাভীর রূপ ধারণ করলেন, প্রজাপতি বৃষ হলেন, এভাবে ও অজ-অজা, গর্ধব-গর্ধবী, এমনকি পিঁপড়া পর্যন্ত যত প্রকার মৈথুন আছে।  সেই সব রূপেই মৈথুন হলো শক্তি  উৎপন্ন হলো। 

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র কাম ও মৈথুনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে। সেখানে পাশ্চাত্য ঈশ্বর কাম ও মৈথুন ছাড়াই জগতে জীব সৃষ্টি করেছে। 

পাশ্চাত্য কাম ও মৈথুন বিহীন সৃষ্টি সাংসারিক জীবনকে বিকৃত করেছে। যেমন, পুরান অনুসারে কামদেব নিজের শক্তি প্রয়োগ করে ব্রহ্মা ও ব্রহ্মার পুত্রদের ঘাম ও বীর্য স্খলন করিয়েছে। সেই বীর্য থেকে বিভিন্ন মানব জাতি ও বিভিন্ন পশু পাখি ও প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে।

সেখানে পাশ্চাত্য ঈশ্বর এক নারী ও পুরুষ সমগ্র মানব জাতি তৈরী করেছে। এর ফলে আদম ও ইভের (হবা) সন্তানরা স্বপিণ্ড অর্থাৎ, ভাই ও বোনদের মধ্যে মৈথুন প্রমাণিত হচ্ছে।

অ্যাব্রাহামিক ধর্মে (বাইবেলের জেনেসিস, কুরআনের সুরা আল-বাকারা) ঈশ্বর (যিহোবা বা আল্লাহ) কাম বা মৈথুন ছাড়াই সৃষ্টি করেন। আদমকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়, এবং ইভকে (হবা) আদমের পাঁজর থেকে। এরপর তাঁদের সন্তানরা (কেইন, অ্যাবেল, সেথ এবং অন্যান্য) থেকে সমগ্র মানবজাতি উৎপন্ন হয়। এটি "স্বপিণ্ড" বা ভাই-বোনের মধ্যে মৈথুন (ইনসেস্ট) নির্দেশ করে, এটি একটি সাধারণ সমালোচনা।

 ধর্মীয় আলোচকরা বলেন:

বাইবেলে (জেনেসিস ৪-৫) আদম-ইভের সন্তানদের মধ্যে বিবাহ এবং সন্তান উৎপাদনের কোনো স্পষ্ট বর্ণনা নেই, কিন্তু লজিক্যালি এটি ইনসেস্ট ছাড়া সম্ভব নয়। খ্রিস্টান অ্যাপোলোজিস্টরা যুক্তি দেন যে তখন ইনসেস্ট নিষিদ্ধ ছিল না (লেভিটিকাস ১৮:৬-১৮-এ পরে নিষিদ্ধ হয়েছে), এবং আদম-ইভের জেনেটিক্স পারফেক্ট ছিল তাই কোনো জেনেটিক ডিফেক্ট হয়নি।

ইসলামে (কুরআন)ও আদম-হবার সন্তানদের মধ্যে বিবাহের ইমপ্লিকেশন আছে, কিন্তু কিছু হাদিসে বলা হয় যে আল্লাহ সেই সময় ইনসেস্টকে অনুমোদন করেছিলেন, পরে হারাম করেছেন।

 এটি সমালোচকদের মতে সাংসারিক জীবনকে "বিকৃত" করে, কারণ এতে যৌনতা পাপের সাথে যুক্ত (যেমন অরিজিনাল সিন) এবং সৃষ্টি অ-যৌনভাবে দেখানো হয়।

হরফ প্রকাশনীর অপব্যাখ্যা:

হরফ প্রকাশনীর যেভাবে অর্থের অনর্থ করেছে , সেটার একটি নমুনা একবার দেখুন। প্রথমে  হরফ প্রকাশনীর অনুবাদ তুলে ধরলাম :

অথ ইতি (এই প্রকারে, হস্ত দ্বারা দেখাইয়া বলিল "এই প্রকরে ") অভি অমন্থৎ ( মন্থন করিলেন )। সঃ মুখাৎ চ যোনেঃ ( মুখরুপ যোনি হইতে ; যোঁন --উৎপাত্ত স্থান)  হস্তাভ্যাম চ (হস্ত হইতে ) অগ্নিম অসৃজত (????) । 

এখানে অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করে, ভাবার্থ পরিবৰ্তন করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং অনুবাদ অসম্পূর্ন রেখে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। 

  এবার আভিধানিক অর্থ দেখুন :

অথ ইতি (অতএব এভাবে ) অভিঅমন্থৎ (মন্থন করে) সঃ মুখাৎ চ যোনেঃ  (তিনি  পর্য্যন্ত)  হস্তাভ্যাম চ ( দুই হাত দিয়ে ) অগ্নিম অসৃজত  (আগুন সৃষ্টি করলেন।)

অর্থাৎ অতএব এভাবে দুই হাতে মন্থন অগ্নি সৃষ্টি করলেন, মুখ থেকে যোনি প্রদেশ পর্যন্ত।

সমাধান:

অর্থাৎ, এখানে ব্রহ্মা ও তাঁর কন্যা প্রসঙ্গে অজাচার সিদ্ধ হয় না।  হিন্দু ধর্মে কলুষতা নেই। হিন্দু ধর্মের জ্ঞান ও গরিমা বুঝতে হলে, শাস্ত্রের রহস্য জানতে হলে গুরুর সান্নিধ্য প্রয়োজন। 

যেভাবে ডাক্তারি বই পড়ে কেউ ডাক্তার হতে পারে না। উচ্চতর গণিতের প্রণালী না বুঝে গণিতকে আবোল তাবোল বলা উচিত না। সেভাবেই শাস্ত্রের ব্যাখ্যা কেবল শাস্ত্রের দৃষ্টিতেই দেখতে হয়। 

আমরা সেই উদ্দেশ্যেই এই ওয়েবসাইট শুরু করেছি। আমাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের সাহায্য করুন। শেষ পর্যন্ত পররা জন্য আমদের পক্ষ থেকে —

ধন্যবাদ!


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Advertisement