মূলনিবাসী ও আর্য বহিরাগত তত্ত্ব কতটা সত্য?

আর্য বহিরাগত, এই তত্ত্ব দিয়েছেন একজন বহিরাগত। আর্যকে একটি জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন একজন বহিরাগত জার্মান ভাষা তত্ত্ববিদ। কিন্তু যারা এই বহিরাগত তত্ত্বকেই সত্য হিসেবে মনে করছে, তারা নিজেদের ভারতের মূল নিবাসী বলেন। অর্থাৎ যে পাত্রে থু থু ফেলে, সেই পাত্র চেটে খায়।

হ্যা, আর্যরা যে উন্নত এবং সভ্যজাতি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো: এই আর্য করা? আর দ্রাবিড় জাতিকে কি তারা সভ্যতা, সংস্কৃতি দিয়ে শিক্ষিত করেছেন?

ম্যাক্স মুলার ও আর্য বহিরাগত তত্ত্ব 

ফ্রেডরিখ ম্যাক্স মুলার এবং উইলিয়াম জোনসের কাজের মাধ্যমে "ইন্দো-ইউরোপীয়" ভাষা পরিবারের ধারণা উঠে আসে, যা পরবর্তীতে "আর্য আক্রমণ তত্ত্ব" (Aryan Invasion Theory) হিসেবে প্রচারিত হয়। 

এই তত্ত্ব অনুসারে, মধ্য এশিয়া থেকে আর্যরা ভারতে এসে এখানকার স্থানীয় দ্রাবিড় বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে। 

আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও জেনেটিক প্রমাণ (যেমন, রাখিগড়ির DNA গবেষণা) এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তাই, AIT তত্ত্ব নিয়ে কথা বলা অনেক গবেষক "আর্য অভিবাসন তত্ত্ব" (Aryan Migration Theory) এর পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে। যেখানে আক্রমণ নয়, আর্য অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে।

ম্যাক্স মুলারের ওই তত্ত্বকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের "Divide and Rule" নীতির অংশ হিসেবে দেখা হয়, যা ভারতীয় সমাজে আর্য ও দ্রাবিড়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল।

তবে, ম্যাক্স মুলারকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়। কারণ, তিনি সেই সময়ে যা প্রমাণ পেয়েছিলেন। সেটাই বলেছিলেন। কিন্তু ২০২৫ সালেও আমাদের ভারতীয় ঐতিহাসিকরা ওই পূরাতন আর্য বহিরাগত তত্ত্বকেই ধরে বসে আছে। 

আর্য কি ভারতের মূল নিবাসী?

সমগ্র বিশ্বের মানব আফ্রিকা থেকে এসেছে। আফ্রিকা ছাড়াও এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানেও আদিম মানবের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আফ্রিকার মানব জাতির সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানেও আদিম মানবের DNA মিলন ঘটে আজকের মানব জাতির উৎপত্তি হয়েছে।

রাখিগড়ির DNA প্রমাণের উল্লেখ থেকে দেখা যায় যে আর্যরা সম্ভবত ভারতেরই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল। 

সরস্বতী নদীর তীরে আর্যাবর্তের অস্তিত্ব এবং বৈদিক সাহিত্যে "আর্য" শব্দটির ব্যবহার (যেমন, ঋগ্বেদে) ইঙ্গিত দেয় যে "আর্য" একটি সাংস্কৃতিক ও মর্যাদাসূচক সম্বোধন, কেবল জাতিগত পরিচয় নয়। এটি বীরত্ব, শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরূপ, রামায়ণ ও মহাভারতে "আর্য" শব্দটি রাবণের স্ত্রী রাবণের জন্য, এবং রাজা দশরথের জন্য ব্যবহার করেছেন।

মহাভারতে ঋষিদের আর্য বলে সন্মান প্রদর্শন করেছেন। গীতায় অর্জুনকে আর্য পুত্র বলা হয়েছে। তাই, আর্য শব্দটি সম্মান সূচক। অপর দিকে ম্লেচ্ছ, শূদ্র অপমান সূচক। 

রাখিগড়ির জেনেটিক গবেষণা (২০১৯) দেখায় যে হরপ্পা সভ্যতার মানুষের মধ্যে মধ্য এশিয়ার স্টেপ জনগোষ্ঠীর জিনের উপস্থিতি কম ছিল, যা "আর্য আক্রমণ" তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায়। তবে, এই গবেষণা এখনো পুরোপুরি স্বীকৃত নয়, এবং কিছু গবেষক এটিকে "ফ্রিঞ্জ" বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

আর্য কি শুধুই একটি সম্মানসূচক সম্বোধন?

"আর্য" শব্দটি প্রাচীন ভারতে একটি মর্যাদাসূচক সম্বোধন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা বীর, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। এটি জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক গুণের প্রতীক। যারা এই মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হতো, তাদের "শূদ্র" বা "ম্লেচ্ছ" বলা হতো, যা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অবস্থান নির্দেশ করতো, জাতিগত নয়।

আরেকটি মত বলে, আর্য এই ভারত বর্ষের আর্য ঋষিদের জাত। কারণ, সরস্বতী নদীর তীরে আর্যাবর্ত নামে ভারতে একটি প্রদেশ ছিলো। যেখানে আর্য সংস্কৃতির উদ্ধব হয়। যেভাবে আমেরিকায় যারা বাস করেন তাদের বলা হয় আমেরিকান। জাপানে বসবাসকারীদের বলা হয় জাপানি। হিন্দুস্তান নামক স্থানে বসবাস কারীদের বলা হয় হিন্দু। সেরকমই আর্য ভূমিতে বসবাসকারীদের বলা হয় আর্য। 

আর্য কেবল একটি জাতি নয় বরং এটি একটি মর্যাদা সূচক সম্বোধন। যেমন নামের আগে শ্রীমান, মহাশয়, স্যার, লর্ড, ইত্যাদি পদ ব্যাবহার করা হয়। প্রাচীন কালে (রামায়ণ, মহাভারতের যুগে) বীর, শিক্ষিত মানুষদের আর্য বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

যারা এই সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বা সেই মর্যাদা অর্জন করতে পারে নাই। তাদের শূদ্র, ম্লেচ্ছ, কুসংস্কারী, ভীরু, দুর্বল ইত্যাদি বলে হেয় করা হয়েছে। অর্থাৎ, আর্য কেবল ভাষা বা জাতিসূচক জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি সম্মান সুচক সম্বোধন।

রাখিগর থেকে পাওয়া প্রত্ন তাত্ত্বিক প্রমাণের DNA স্যাম্পেল বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রমাণ হয় যে, আর্যরা বিদেশ থেকে নয় বরং, আগে থেকেই ভারতের বাসিন্দা ছিলো। তাই আর্য India Out Theory জোর পেতে থাকে। যদিও পাশ্চাত্য কিছু আর্কিওলজিস্ট একে ফ্রিঞ্জ বলে উপেক্ষা করেছেন।

দ্রাবিড় কি আলাদা জাতি?

ঐতিহাসিক ও জেনেটিক গবেষণার আলোকে, "দ্রাবিড়" শব্দটি প্রাথমিকভাবে একটি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বোঝায়, জাতিগত নয়। দ্রাবিড় ভাষা পরিবার (যেমন, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম) ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে প্রচলিত, এবং এই ভাষাগুলির ব্যবহারকারীদের "দ্রাবিড়" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

তবে, জেনেটিক গবেষণা (যেমন, রাখিগড়ির DNA বিশ্লেষণ) ইঙ্গিত দেয় যে ভারতীয় উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীতে আর্য বা দ্রাবিড় হিসেবে সুস্পষ্ট জাতিগত বিভাজন নেই। বরং, হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে।




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Advertisement