মূলনিবাসী ও আর্য বহিরাগত তত্ত্ব কতটা সত্য?

ভারত একটি পন্থ-নিরপেক্ষ, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ।  বহু জাতি , ভাষা , সংস্কৃতি এই একটি দেশেই দেখা যায়।  তাই , অনেকে একে  উপ মহাদেশ বলে থাকেন। এর মধ্যে মূলনিবাসী ও আর্য বহিরাগত তত্ত্ব ঢুকে গেছে।  যা ভারতের  সার্বভৌমত্বকে আঘাত করছে।

আর্যরা বহিরাগত, এই তত্ত্ব দিয়েছেন একজন বহিরাগত বিদেশী। 'আর্য' শব্দটিকে একটি জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন একজন বহিরাগত জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ। কিন্তু যারা এই আর্যরা বহিরাগত তত্ত্বকেই সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে, তারা নিজেদের ভারতের মূল নিবাসী বলেন। আর্য ঋষিরা নিজেদের কখনোই বহিরাগত অর্থাৎ বিদেশী বলেনি। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু সনামধন্য ঐতিহাসিক, নেতা-মন্ত্রীরা মূলনিবাসী ও আর্য তত্ত্বকে নিয়ে রাজনীতি করছে। এই রকম বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ গুলো যে হোটেলের দুর্নাম করে, সেই হোটেলেই খেয়ে যায়।


আর্যরা উন্নত এবং সভ্য জাতি এ বিষয়ে হিন্দু শাস্ত্র এবং লোক শ্রুতিতে কোনো পার্থক্য নেই। এ নিয়ে কোনো সন্দেহও নেই যে আর্য সংস্কৃতি বলে একটি সংস্কৃতি ছিলো। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে আর্য  সংস্কৃতিকে জাতি হিসেবে বর্ণনা তুলে  ধরে যেভাবে দূষিত করা হয়েছে, তাতে কেউ দুধের বাটিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। 

 প্রশ্ন হলো: এই আর্য করা? আর্যরা কি দ্রাবিড় জাতিকে শোষণ করে নিজের হিন্দু সংষ্কৃতি তৈরী করেছেন?

ম্যাক্স মুলার ও আর্য বহিরাগত তত্ত্ব 

ফ্রেডরিখ ম্যাক্স মুলার এবং উইলিয়াম জোনসের কাজের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষা "ইন্দো-ইউরোপীয়" ভাষার পরিচয় পায়। যা পরবর্তীতে "আর্য আক্রমণ তত্ত্ব" (Aryan Invasion Theory) কে বল প্রদান করে এবং  আর্য আক্রমণ তত্ত্ব ভারতের ইতিহাস পাঠ্য পুস্তকে স্থান পায়।  যদিও যিনি আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে প্রথম বার সবার সামনে তুলে ধরেছেন, তিনি কেবল এটিকে একটি সম্ভাবনা বলেই উল্লেখ করেছেন। ইটা ঐতিহাসিকদের কেরামতির ফল আজ ওই অনুমান রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে গেছে।  

এই তত্ত্ব অনুসারে, মধ্য এশিয়া থেকে আর্যরা ভারতে এসে এখানকার স্থানীয় দ্রাবিড় বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে। আর্যরা নিজেদেরকে দেবতা আর স্থানীয় দ্রাবিড়দের অসুর সংষ্কৃতির নাম দেয়। — এই তত্ত্ব কতটা সঠিক? 

আর্যরা নিজেদেরকে দেবতা কখনোই বলেননি বরং আসুর  ও দেবতা উভয়ই ঋষি কশ্যপের অদিতি ও দিতির পুত্র বলে  বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋক বেদের অনেক জায়গায় ইন্দ্র , বরুণ  ও অগ্নিদেবকে অসুর বলা হয়েছে।   অসুর কথার অর্থ ছিল বলশালী, এরা গো সম্পদ (পৃথিবীর সম্পদ ) রক্ষা করতো বলে এদের রাক্ষস বলা হতো। অর্থাৎ অসুর ও রাক্ষস এক সময় উত্তম অর্থে ব্যবহার হতো।

এই অসুর শব্দ থেকে আহুরা এবং আহুরা থেকে ইয়াহবা শব্দের অপভ্রংশ হয়েছে।  আর দেব থেকে দৈব , এবং দৈব থেকে ডেভিল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।  মহাভারত, রামায়নের যবন, শক, হুন জাতির উল্লেখ আছে।  যারা বহিরাগত ছিলেন।  এদের ম্লেচ্ছ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে আর্য  কিভাবে বহিরাগত হবে?   

এই নিয়ে, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে বহু যুক্তি প্রমাণের বিশাল বিরোধ আছে। কারন, প্রত্নতত্ত্ব প্রমাণ দিয়ে কথা বলে, ঐতিহাসিক সেই প্রমাণ থেকে নিজেদের চিন্তাধারার অনুরূপ প্রমাণ বাছাই করে বাকিগুলো সরিয়ে রাখে। অর্থাৎ মিথ্যা কে সত্য রূপে খানিকটা কায়দা করে বর্ণনা করে।  এটা কলমের একটি কলা।  

প্রত্নতত্ত্ব প্রমাণ থেকে প্রথমে মনে করা হয়েছিলো আর্যরা বহিরাগত। এই তত্ত্বের সত্যতা যাচাই না করেই আমদের দেশের বহু মহাপুরুষ সেটাই সত্য বলে মেনে নেয়। DNA প্রমাণ থেকেও আর্য আক্রমণ তত্ত্ব এতদিন সত্যি বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও জেনেটিক প্রমাণ (যেমন, রাখিগড়ির DNA গবেষণা) থেকে এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়ছে। তাই, AIT তত্ত্ব নিয়ে কথা বলা অনেক গবেষক "আর্য অভিবাসন তত্ত্ব" (Aryan Migration Theory) এর পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে। যেখানে আক্রমণ নয়, আর্য অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে।

ম্যাক্স মুলারের ওই তত্ত্বকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের "Divide and Rule policy" নীতির অংশ হিসেবে দেখা হয়, যা ভারতীয় সমাজে আর্য ও দ্রাবিড়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল।

তবে, ম্যাক্স মুলারকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়। কারণ, তিনি সেই সময়ে যা প্রমাণ পেয়েছিলেন। সেটাই বলেছিলেন। ২০২৫ সালেও আমাদের ভারতীয় ঐতিহাসিকরা ওই পূরাতন আর্য বহিরাগত তত্ত্বকেই ধরে বসে আছে। এটাই আপত্তি।  আসলে এরা  কি চায় ? সেটাই স্পষ্ট নয়। 

আর্য কি ভারতের মূল নিবাসী?

ডিএনএ ম্যাপিং করে এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে সমগ্র বিশ্বের মানব আফ্রিকা থেকে এসেছে। আফ্রিকা ছাড়াও এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানেও আদিম মানবের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আফ্রিকার মানব জাতির সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানেও আদিম মানবের DNA মিলন (বিবাহ) ঘটে আজকের মানব জাতির উৎপত্তি হয়েছে।

রাখিগড়ির DNA প্রমাণের উল্লেখ থেকে দেখা যায় যে আর্যরা বহিরাগত নয় বরং ভারতেরই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল। যাদের দ্রাবিড় বলা হচ্ছে , তারাই আর্যদের পূর্বসূরী।   

বেদ তথা স্মৃতি শাস্ত্রে সরস্বতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ওই সরস্বতী নদীর তীরে ব্রহ্মবর্ত ও আর্যাবর্তের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।  যা আর্য আক্রমণ করার বহু আগেই শুকিয়ে গিয়েছিলো। তাহলে কিভাবে বেদ তথা স্মৃতিতে উল্লেখ থাকবে ? 

এছাড়াও বৈদিক সাহিত্যে "আর্য" শব্দটির একটি সাংস্কৃতিক ও মর্যাদাসূচক ব্যবহার (যেমন, ঋগ্বেদে) ইঙ্গিত দেয় যে এটি জাতিগত পরিচয় নয়। এটি বীরত্ব, শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরূপ, রামায়ণ ও মহাভারতে "আর্য" শব্দটি রাবণের স্ত্রী রাবণের জন্য, এবং কৈকেয়ী রাজা দশরথের জন্য ব্যবহার করেছেন।

মহাভারতে ঋষিদের হে আর্য বলে সন্মান প্রদর্শন করেছেন। গীতায় অর্জুনকে আর্য পুত্র বলা হয়েছে। অর্থাৎ, এই আর্য শব্দটি সম্মান সূচক। অপর দিকে ম্লেচ্ছ, শূদ্র অপমান সূচক। 

রাখিগড়ির জেনেটিক গবেষণা (২০১৯) দেখায় যে হরপ্পা সভ্যতার মানুষের মধ্যে মধ্য এশিয়ার স্টেপ জনগোষ্ঠীর জিনের উপস্থিতি কম ছিল, যা "আর্য আক্রমণ" তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায়। তবে, এই গবেষণা কিছু গবেষক এটিকে "ফ্রিঞ্জ" বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

আর্য কি শুধুই একটি সম্মানসূচক সম্বোধন?

"আর্য" শব্দটি প্রাচীন ভারতে একটি মর্যাদাসূচক সম্বোধন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা বীর, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। এটি জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক গুণের প্রতীক। যারা এই মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হতো, তাদের "শূদ্র" বা "ম্লেচ্ছ" বলা হতো, যা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অবস্থান নির্দেশ করতো, জাতিগত নয়।

আরেকটি মত বলে, আর্য এই ভারত বর্ষের আর্য ঋষিদের জাত। কারণ, সরস্বতী নদীর তীরে আর্যাবর্ত নামে ভারতে একটি প্রদেশ ছিলো। যেখানে আর্য সংস্কৃতির উদ্ধব হয়। যেভাবে আমেরিকায় যারা বাস করেন তাদের বলা হয় আমেরিকান। জাপানে বসবাসকারীদের বলা হয় জাপানি। হিন্দুস্তান নামক স্থানে বসবাস কারীদের বলা হয় হিন্দু। সেরকমই আর্য ভূমিতে বসবাসকারীদের বলা হয় আর্য। 

আর্য কেবল একটি জাতি নয় বরং এটি একটি মর্যাদা সূচক সম্বোধন। যেমন নামের আগে শ্রীমান, মহাশয়, স্যার, লর্ড, ইত্যাদি পদ ব্যাবহার করা হয়। প্রাচীন কালে (রামায়ণ, মহাভারতের যুগে) বীর, শিক্ষিত মানুষদের আর্য বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

যারা এই সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বা সেই মর্যাদা অর্জন করতে পারে নাই। তাদের শূদ্র, ম্লেচ্ছ, কুসংস্কারী, ভীরু, দুর্বল ইত্যাদি বলে হেয় করা হয়েছে। অর্থাৎ, আর্য কেবল ভাষা বা জাতিসূচক জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি সম্মান সুচক সম্বোধন।

রাখিগর থেকে পাওয়া প্রত্ন তাত্ত্বিক প্রমাণের DNA স্যাম্পেল বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রমাণ হয় যে, আর্যরা বিদেশ থেকে নয় বরং, আগে থেকেই ভারতের বাসিন্দা ছিলো। তাই আর্য India Out Theory জোর পেতে থাকে। যদিও পাশ্চাত্য কিছু আর্কিওলজিস্ট একে ফ্রিঞ্জ বলে উপেক্ষা করেছেন।

দ্রাবিড় কি আলাদা জাতি?

ঐতিহাসিক ও জেনেটিক গবেষণার আলোকে, "দ্রাবিড়" শব্দটি প্রাথমিকভাবে একটি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বোঝায়, জাতিগত নয়। দ্রাবিড় ভাষা পরিবার (যেমন, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম) ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে প্রচলিত, এবং এই ভাষাগুলির ব্যবহারকারীদের "দ্রাবিড়" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

তবে, জেনেটিক গবেষণা (যেমন, রাখিগড়ির DNA বিশ্লেষণ) ইঙ্গিত দেয় যে ভারতীয় উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীতে আর্য বা দ্রাবিড় হিসেবে সুস্পষ্ট জাতিগত বিভাজন নেই। বরং, হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে।

এই বিষয়ের আপনার মতামত আমাদের লিখে জানান। 


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Advertisement