যুক্তির আলোয় ধর্মচিন্তা: হিন্দু দর্শনে ন্যায়শাস্ত্র ও হেত্বাভাসের বিশ্লেষণ


ঋষিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গভীর, মুক্তচিন্তাশীল এবং বিশ্লেষণভিত্তিক। তারা কেবল ঈশ্বর বা আত্মা বিষয়ে ভাবেননি, বরং জ্ঞান কীভাবে আসে, ভুল কীভাবে হয়, কেন কিছু সত্য মনে হয় অথচ তা মিথ্যা হয়—এসব বিষয়ে তারা তর্ক ও বিশ্লেষণ করেছেন। ন্যায়শাস্ত্র তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ন্যায়শাস্ত্র হল প্রাচীন ভারতের যুক্তিবিদ্যা ও তর্কশাস্ত্র, যা যৌক্তিক বিশ্লেষণ, প্রমাণপদ্ধতি ও জ্ঞানার্জনের নিয়ম ব্যাখ্যা করে। এর মূল প্রণেতা আচার্য গৌতম, যিনি ন্যায়সূত্র রচনা করে চিন্তার একটি সুসংহত কাঠামো গড়ে তোলেন। 

ন্যায়শাস্ত্র মতে, সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য পাঁচটি প্রমাণ বা প্রমাণ—প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শাব্দ এবং অনুপলব্ধি—ব্যবহার করা হয়। এটি শুধু দর্শনের একটি শাখা নয়, বরং বিজ্ঞান, ধর্ম, ও সমাজচিন্তার গভীর ভিত্তি নির্মাণ করে, যেখানে যুক্তির সাহায্যে ভ্রান্তি (হেত্বাভাস) চিহ্নিত করে প্রকৃত জ্ঞান লাভের পথ দেখানো হয়।

গুরু-শিষ্য পরম্পরায় শিক্ষাদানের সময় এটি ছিল অপরিহার্য বিষয়, যেখানে প্রশ্নোত্তর ও তর্কের মাধ্যমে জ্ঞানের গভীরে পৌঁছানো হতো। ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, চিকিৎসা, আইন ও বিচারব্যবস্থাতেও ন্যায়শাস্ত্রের প্রমাণপদ্ধতি ও হেতুবিচার প্রয়োগ হতো। বিশেষত, বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু দর্শনের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ ও প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায়শাস্ত্র একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। এছাড়া, গুরুতর ধর্মীয় ও সামাজিক তর্কের মঞ্চেও এটি ব্যবহৃত হতো সত্য ও ভ্রান্তির পার্থক্য নির্ধারণে। 

হেত্বাভাস কী?

ন্যায়দর্শনের ভাষায় হেত্বাভাস মানে "ভ্রান্ত হেতু" বা ভুল যুক্তি। হেতু (কারণ বা প্রমাণ) যদি আপাতভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হয় কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যায় তা যুক্তিসঙ্গত নয়, তখন সেটি হেত্বাভাস।

হেতুরূপতা আপাততঃ প্রতীতির পশ্চাৎ তদভিন্নতা হেত্বাভাসঃ।”

অর্থ: যে হেতু প্রথমে সত্য বা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, কিন্তু পরে দেখা যায় তা প্রকৃত হেতু নয়—তাকেই হেত্বাভাস বলে।

হেত্বাভাসের বিভাগ:

হিন্দু ন্যায়শাস্ত্র তৈরী হয়  হয়েছিল নাস্তিক বাদকে খণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে। ন্যায় শাস্ত্র অনুযায়ী পাঁচটি প্রধান হেত্বাভাস আছে :

১. সব্যভিচার (Savyabhichara) – 

যে হেতু (বা যুক্তি) সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সেটি সর্বত্র প্রযোজ্য নয় বা ওই যুক্তি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়, অর্থাৎ সেই হেতু অনিয়মিত (irregular)। কারণ, হেতু যদি সাধারণতা বজায় রাখতে না পারে, মানে সর্বত্র সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, তাহলে সেটি ভ্রান্ত যুক্তি।

তর্ক:  “যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে আগুন আছে। পাহাড়ে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, তাই সেখানে আগুন জ্বলছে।”

প্রতিউত্তর (Counter-example):

মেঘ বা কুয়াশা দেখতে ধোঁয়ার মতো, বা বরফ থেকেও ধোঁয়ার মতো বাষ্প উঠতে পারে। বাষ্প দেখে ধোঁয়ার ভ্রম হতে পারে। তাই — সেখানে আগুন নেই। এখানে প্রমাণ ও তর্ক উভয়ই অপ্রত্যক্ষ। তাই, প্রত্যক্ষে প্রমাণ সিদ্ধ হয়। রাতের অন্ধকারে দড়িকে সাপ ভেবে ভ্রম হয় বা কাপড়কে ভূত ভেবে। এখানে প্রমাণ প্রত্যক্ষ হলেও ভ্রম। এর 

২. বিরুদ্ধ (Viruddha)

বিরুদ্ধঃ প্রতিপাদ্যবিপরীতবোধক হেতুঃ।

অর্থাৎ, যে হেতু সিদ্ধান্তের বিপরীত বোঝায়, তাকে বিরুদ্ধ হেতু বলে। 

উদাহরণ:

 "ধর্ম এই পৃথিবীতে মানবতার জন্য অভিশাপ। কারণ , যত খুনোখুনি, বর্ন ও জাতি বৈষম্য, অন্ধ বিশ্বাস ধর্মের কারণে হয়।"

প্রতিউত্তর

হেতু নিজেই সিদ্ধান্তকে বিরোধ করে। ধর্ম মানবতার জন্য অভিশাপ হতেই পারে না। অধর্মের ধর্ম হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কারণ ধর্মের প্রকৃত অর্থই হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, আত্ম উন্নয়ন, এবং সকল প্রাণীর মঙ্গলের পথনির্দেশ। 

যে বিশ্বাস বা প্রতিষ্ঠান ঘৃণা, সহিংসতা, বৈষম্য, অন্ধ আনুগত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির দমন ঘটায়—তাকে ধর্ম নয়, বরং অধর্ম বলা উচিত। তাই কোনো কিছুকে "ধর্ম" নামে চিহ্নিত করলেই তা ধর্ম হয়ে যায় না। দেখতে হবে, সেটি সত্য, ন্যায়, দয়া ও বিবেকের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। প্রকৃত ধর্ম কখনোই মানবতার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না; বরং ধর্ম যদি সত্যিকার অর্থে ধর্ম হয়, তবে সেটিই মানবতার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।

তাই, বিরুদ্ধ হেত্বাভাস চিনতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সাধারণ বিতর্কে খুব সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করে।

একটি বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে, কিন্তু ‍যখন ‍হেতু বিশ্লেষণ করা হয়, তখন দেখা যায় ‍সেটি ‍নিজেরই বিপরীত যুক্তি দাঁড় করায়।

৩. অসিদ্ধ (Asiddha) 

“সাধ্যাশ্রয়ানুপলব্ধিত্‌বাত্ হেতোরসিদ্ধতা।”

অর্থাৎ, ‍যে হেতুর উপর সিদ্ধান্ত দাঁড় করানো হচ্ছে, তারই অস্তিত্ব বা উপস্থিতি অনির্দিষ্ট বা অপ্রমাণিত, তখন ‍সেই হেতুকে অসিদ্ধ বলে।

উদাহরণ:

 " ব্রাহ্মণরা শূদ্র কে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।"

প্রতিউত্তর

ব্রাহ্মণরা এই বঞ্চিত করে রেখেছে —দাবিরই প্রমাণ নেই। কারণ, ব্রাহ্মণ বেদ অধ্যয়ন, ও ব্রাহ্মণ্যচিত সদাচার ত্যাগ করে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন। এবং শূদ্র মানেই নিরক্ষর বা অশিক্ষিত নয়। কারণ, শাস্ত্রে বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ কখনও যেন শূদ্র শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহন না করে। এখানে অসিদ্ধ ও বিরুদ্ধ উভয় প্রকার উদাহরণ পাওয়া যায়।

৪. সত্ প্রতিপক্ষ 

যৎ হেতু: তস্য প্রতিনিয়ায়কসত্ হেতুনা প্রতিপক্ষতা সত্প্রতিপক্ষঃ।

অর্থাৎ, ‍যে হেতু দিয়ে সিদ্ধান্ত প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে, ‍তার বিপরীতে ‍যদি ‍একটি সমতুল্য বা ‍সত্য-প্রমাণিত হেতু থাকে, ‍তবে ‍সেই ‍মূল ‍হেতুটি ‍সত্ প্রতিপক্ষ দ্বারা ‍বিবর্ণ ‍বা ‍অস্থির ‍হয়ে ‍পড়ে।

উদাহরণ:

মনুস্মৃতিতে নারীর অধিকার খর্ব করা হয়েছে। নারীকে দাসী ও পুরুষের অধীন বলা হয়েছে।

প্রতিউত্তর

মনুস্মৃতিতেই নারীকে পূজনীয় বলা হয়েছে, নারীর রক্ষা করাকে পুরুষের কর্তব্য বলা হয়েছে।

‍যেমন: "যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা:" — যেখানে নারীকে পূজা করা হয়, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন। এবং  "মাতৃবৎ পরদারেষু" — অন্যের স্ত্রীকে মায়ের মতো দেখা উচিত।

নারীকে কখনোই একা রাখা উচিত নয়—শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র তাকে রক্ষা করবে।

৫. বাধিত

প্রমাণান্তরবাধিত হেতু: বাধিত:”

অর্থাৎ, ‍যে হেতু অন্য কোনো প্রমাণ (যেমন: প্রত্যক্ষ জ্ঞান, শাস্ত্র, অনুমান বা যুক্তি) দ্বারা খণ্ডিত হয়, তাকে বাধিত হেতু বলে। যেমন —"যা নেই, সেটিকেই সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, এবং পরে নিজেই সেটাকে খণ্ডন করা" অর্থাৎ পুরো বিষয়টাই একটি মিথ্যা ভিত্তির উপর দাঁড়ানো। 

বাধিত হেত্বাভাস হলো এমন যুক্তি যা প্রথমে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও, পরে ‍বিশ্বস্ত প্রমাণ দ্বারা ‍খণ্ডিত হয়ে পড়ে। এই হেত্বাভাস যুক্তি বিশ্লেষণে বিশেষ গুরুত্ব রাখে, কারণ তা আমাদের শেখায়—যেকোনো ‍যুক্তি প্রমাণযোগ্য সত্যের ভিত্তিতে দাঁড়াতে হবে, কল্পনা বা আপাতবোধে নয়।

উদাহরণ

হিন্দু সমাজে সতী প্রথা একটি কুসংস্কার ছিলো। যেখানে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো। আবার বলা হয় হিন্দু বিধবাদের ব্রত কঠিন তাই এটাও একটা কু সংস্কারের উদাহরণ।

প্রতিউত্তর: 

এখানে  প্রথমে যে সিদ্ধান্তটি বা আরোপটি করা ধরা হয়েছে সেটি পরের সিদ্ধান্ত দ্বারা খণ্ডিত হচ্ছে। কারণ প্রথমে বলা হয়েছে বিধবাদের পুড়িয়ে মারা হতো। আবার বলা হচ্ছে বিধবাদের ব্রত কঠিন। বিধবাদের যদি পুড়িয়েই মারার প্রথা থাকতো তবে কোন বিধবা ব্রত করছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় প্রথমটির অস্তিত্বই নেই, তাই সেটি হেতু হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। একে বলা হয়অসিদ্ধ হেতু। হেতু সিদ্ধ না হওয়ায় প্রত্যক্ষ বা গ্রহণযোগ্য জ্ঞানে সেটি বাধিত হেতু নিজেই খণ্ডিত হয়।

পরিশিষ্ট:

হিন্দু ধর্মের ঋষি ও গুরুরা ছিলেন যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ। প্রাচীন ভারতে ঋষিরা অন্ধ বিশ্বাসে নয়, বরং অনুভব (experience), প্রত্যক্ষ (observation), অনুমান (inference) এবং যুক্তি (reason)-র ভিত্তিতে সত্য অনুসন্ধান করতেন। তাদের দর্শন ছিল প্রশ্ননির্ভর—“কেন? কীভাবে? সত্য কী?” এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই জন্ম নিয়েছে উপনিষদ, ন্যায়শাস্ত্র, সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, ইত্যাদি বিভিন্ন দার্শনিক শাখা।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়—হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ঋষিরা ছিলেন যুক্তিনিষ্ঠ, বিশ্লেষণমূলক ও রেশানাল চিন্তাধারার পথপ্রদর্শক।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds