Euthyphro's dilemma ও নৈতিকতার উৎস কি ধর্ম নাকি সামাজিক বিবর্তন?

অনেকেই মনে করেন, “ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা সম্ভব নয়”, আবার অনেকে মনে করেন “ধর্মই মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়।” কিন্তু বাস্তবে নৈতিকতা হলো মানুষের সামাজিক ও বিবর্তনীয় গুণ। 

এই যুগে যে কাজ নৈতিক মনে হয়, আমার পরবর্তী প্রজন্মের সময় সেগুলো অনৈতিক হতে পারে। কারণ তখন হয়তো সমাজ অন্য ভাবে ভাববে। নৈতিকতার এই প্রশ্নে। ইউথিফ্রো'স দিলেমা বলে একটি ধারনা আছে। আসুন আলোচনা করি।


 উত্থাপিত যুক্তিটি ইউথিফ্রো দিলেমার (Euthyphro Dilemma) মূল সমস্যা তুলে ধরে, যা মূলত সক্রেটিস প্লেটোর "Euthyphro" সংলাপে উত্থাপন করেছিলেন। সেই প্রশ্নটি হলো—

  1. ঈশ্বর কি যা ভালো, তা শুধু ভালো বলেছেন, নাকি তিনি যেটাকে ভালো বলেন সেটাই ভালো হয়ে যায়?

    • যদি ঈশ্বরের নির্দেশই ভালো-মন্দের একমাত্র ভিত্তি হয়, তবে তিনি যে কোনো কিছুকে ভালো-মন্দ হিসেবে নির্ধারণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে নৈতিকতা স্বেচ্ছাচারী (arbitrary) হয়ে যায়।
    • যদি কিছু জিনিস ঈশ্বরের স্বাধীন সিদ্ধান্তের বাইরেও ভালো হয়, তবে ভালো-মন্দের মানদণ্ড ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে দাঁড়ায়, যা ঈশ্বরকে নৈতিকতার চূড়ান্ত উৎস হিসেবে খণ্ডন করে।

নৈতিকতার উৎস কি ধর্ম, নাকি বিবর্তন?

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে:

  • অনেক ধর্ম দাবি করে যে নৈতিকতা ঈশ্বরপ্রদত্ত, এবং ঈশ্বরের আদেশ মেনে চলাই নৈতিকতার ভিত্তি। তা ছাড়া তাদের কাছে কোনো উপায় নাই।ঈশ্বরের আদেশ না মানলে এই জন্মে তাকে ভোগ করতে হবে ঈশ্বরের নির্দেশিত শাস্তি আর মৃত্যুর পর তাকে ফেলে দেওয়া হবে নরকের আগুনে যেখানে পাথর পর্যন্ত গলে যায়।

বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে:

  • সমাজবিজ্ঞান ও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মতে, নৈতিকতা মানুষের সামাজিক অভিযোজনের (social adaptation) ফল।
  • হাজার বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পেরেছে যে সহযোগিতা, ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও বিশ্বাস সামাজিক টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।
  • ধর্মীয় মূল্যবোধের আগেও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, সহানুভূতি এবং সামাজিক নিয়ম ছিল।

ইউথিফ্রো দিলেমার হিন্দু পক্ষ কী?

হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর নির্দিষ্ট ভাবে কাউকে ভালো বা মন্দ বলে না। কোনো রকমের নৈতিক আদেশ বা কিতাব ঈশ্বরের তরফ থেকে হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। হিন্দু সমাজে বেদ যা বিভিন্ন ঋষিদের দ্বারা প্রণীত হয়েছে সেখানে কোনো রকম বিধি নিষেধ উল্লেখ নেই। সেখানে কেবলই ঈশ্বরের নাম ও গুণগান করা হয়েছে। সেখানে “আমি আদেশ করছি”, “আমি ঈশ্বর বলছি” এরকম কোনো কথা নেই। তাহলে বেদ?

বেদ কি আসমানী কিতাব?

বেদ যারা পড়েছেন তারা দেখবেন, বেদের প্রতিটি মন্ডল বা অধ্যায় কতগুলো সূক্ত বা বিভাগে বিভক্ত। সেই সূক্ত গুলো কোনো না কোনো ঋষির রোচিত মন্ত্রে  প্রতিপাদিত। অর্থাৎ বেদ ঐশ্বরীয় হলেও আসমানী কিতাব নয়। 

ঈশ্বর মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছেন:

মানব লিখিত শাস্ত্র যেমন স্মৃতি, পুরান ও বিভিন্ন দর্শন শাস্ত্রে কিছু সিদ্ধান্তকে তুলে ধরা হয়েছে তেমনি সামাজিক নিয়ম আচরণ উল্লেখ করা হয়েছে এবং সামাজিক যে নৈতিকতার মানদন্ড ছিলো বা আছে, সেগুলোই উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থাৎ, হিন্দু ধর্মে নৈতিক শিক্ষা ঈশ্বর ভিত্তিক হলেও ঈশ্বরকে নৈতিকতার চূড়ান্ত উৎস হিসেবে মনে করা হয় না। বরং সমাজের বিবর্তনকেই দায়ী করা হয়।

 নৈতিক শিক্ষা কিভাবে তৈরী হয়েছে?

পঞ্চতন্ত্রের গল্প গুলোর মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হতো। যেখানে এক একটি বিষয়কে পশু পাখির কথোপকথন দ্বারা তাদের গল্প দ্বারা লেখা হতো। সেই গল্প গুলোই শৈশবে নৈতিক কাঠামো তৈরি করে।

পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো ভারতে খুব জনপ্রিয় এবং সেগুলি বহুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই গ্রন্থটি কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বেশ কিছু সংস্কৃতিতে অনুবাদ হয়েছে। পঞ্চতন্ত্রের মধ্যে একটি নৈতিক বা সামাজিক শিক্ষা প্রচারের সরাসরি প্রভাব বা সম্পর্ক আছে।

নৈতিকতার উৎস ঈশ্বর হলে অনৈতিকতার উৎস কে? 

পাশ্চাত্য সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে নৈতিকতার উৎস ঈশ্বর এবং অনৈতিকতার উৎস শয়তান বা লুসিফরকে ধরা হয়। কারণ মানুষকে এই লুসিফর ভ্রান্ত পথে অগ্রসর করে ইডেন গার্ডেনে ওই নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার জন্য দায়ী করেছিল বা গুমরাহ করেছিলো। শয়তান মানুষের পরীক্ষা নেয়। এই পক্ষপাত হিন্দু ধর্মে নেই। 

আমাদের এখানে আছে দেব সংস্কৃতি, মানব সংস্কৃতি এবং অসুর সংস্কৃতি। মানুষ দান, দয়া, করুণা দ্বারা দেবতা হয়ে পূজিত হয় আর এর বিপরীত ক্রিয়া দ্বারা নিন্দিত। দেবতার থেকেও উর্ধ্বে আছে ঈশ্বরত্ব। যে স্তরে মানুষ উন্নত হলে তাঁকে দেবতারাও পূজা করেন। উদাহরণ: শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ, হনুমান এমনকি শিব পার্বতী। এরা সকলেই মানব থেকে ঈশ্বর হয়েছেন। 

উদাহরণ, রাম ও রাবণ। উভয়ই এই পৃথিবীতেই জন্মেছেন। রাবণ ছিলেন ঋষির পুত্র এবং ব্রাহ্মণ আর শ্রী রাম ছিলেন রাজার পুত্র।

রাবণ নিজের ভাইয়ের সম্পত্তি হরণ করে, আত্মসাৎ করেছে। অন্যায় ভাবে অন্যের ধন হরণ করে, অন্যায় অবিচার করে সোনার লঙ্কা স্থাপন করেছে। তাই, রাবণ ব্রাহ্মণ তথা ঋষি পুত্র হয়েও রাক্ষস রাজ বা অসুর বলে গণ্য।

পুরাণের গল্পগুলো কি বাস্তব?

পুরাণে অনেক গল্প কথা আছে, যার মধ্য দিয়ে দেবতাদের নানা কাহিনী বলা হয়েছে। সেই পুরানের গল্প গুলো আসলে সৃষ্টির সূক্ষ্ম তত্ত্ব গুলোকে ব্যাখ্যা করে। সেই গল্প গুলো বাস্তব নয় বরং বাস্তব জ্ঞান সূত্র।

বিজ্ঞান কোনো সূত্র বা তত্ত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যেমন চিত্রের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করে দেখায়। ঠিক তেমনি বেদ যে কথা গুলো বলছে সেগুলোকেই পুরাণে নকশা আকারে দেখানো হয়েছে।

শিব সতীর বিচ্ছেদ এবং মিলনের কাহিনী আসলে আমাদের আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে যে বিচ্ছেদ সেটাই দর্ষায়। দক্ষ হলো এই দেহ অভিমান, যিনি শিবকে ঈশ্বর মনে করে না, সতী দক্ষের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে যাওয়ার বায়না করে এবং শিবকে দশ মহাবিদ্যার রূপ দর্শন করায়। শিব বিমোহিত হয়ে অনুমতি দেয়। যেভাবে আমরা প্রকৃতির মায়া দ্বারা বিমোহিত। শিব বিহীন যজ্ঞে তিনি অপমানিত হয়ে আত্ম - আহুতি দেন। অর্থাৎ, সর্বনাশ করে ফেলেন। শিব বৈরাগী হয়ে আত্ম গোপন করেন। এখানে শিব হলো আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তি।

এভাবেই রাধা কৃষ্ণের মিলন ও গোপীদের রাস লীলা আত্মা ও পরমাত্মার তত্ত্বকে কাহিনী আকারে বর্ণনা করে। কিন্তু তত্ত্ব জ্ঞান না থাকায় মূর্খরা একে আশ্লীল গল্প মনে করে। 

এই জন্য রাম প্রসাদ লিখেছেন, “জাতি ধর্ম সর্প খেলা... যখন বলবে বাপ সাপ ধরতে তখন হবে অধো মুখি।"

ঈশ্বরের নিরপেক্ষতা 

আমরা দেখেছি, দেবাদিদেব মহেশ্বর , ব্রহ্মা দেবতা এবং অসুর উভয়কেই আশীর্বাদ দিতে। অর্থাৎ তারা নিজেরা দেবতা হয়েও অসুর বা রাক্ষসকে মন্দ বলছে না। ঈশ্বরের মনে পক্ষপাত নেই।

উদাহরণ স্বরুপ, রাক্ষস রাজ প্রহ্লাদ একজন বৈষ্ণব ছিলেন যিনি নারায়ণের নরসিংহ আবতার আনয়নের জন্য দায়ী ছিলেন। তিনি দেবতাদের দ্বারাও পূজিত। তাঁর পৌত্র রাক্ষস রাজ বলি, তিনিও ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে আগামী মন্বন্তরে মনু হিসেবে আসবেন। এমনকি রাহু ও কেতু দেবতা না হয়েও হিন্দু ধর্মের নবগ্রহের অন্তর্গত। নৈতিকতার মানদণ্ডে পক্ষপাতিত্ব ঈশ্বরের নেই। ভালো বা মন্দের নির্ণয় মানুষ নিজের বিবেক দ্বারা করে। প্রমাণ —

শ্লোক:
কর্মণাং চ বিবেকার্থং ধর্মাধর্মৌ ব্যবেচযৎ।
দ্বন্দ্বৈরযোজযচ্চৈমা: সুখদুঃখাদি ভূমিশু প্রজা:। 
(মনুস্মৃতি ১/২৬)

বাংলা অনুবাদ:
কর্মের যথাযথ বিচার করতে জন্য (ঈশ্বর) ধর্ম ও অধর্মকে বিবেক দ্বারা পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এই জগতের সমস্ত প্রাণীদের সুখ-দুঃখ ও অন্যান্য দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

সারাংশ

সনাতন ধর্ম এবং অন্য ধর্মের মধ্যে ইউথিফ্রো দিলেমার প্রসঙ্গে এই পার্থক্য রয়েছে যা, সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের নৈতিকতার সীমানা মানুষের বিবেক, আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং সামাজিক আদর্শের সাথে মিলে যায়। যেখানে ঈশ্বরের আদেশের উপরে ভালো-মন্দের নির্ধারণ অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী নয়। অন্যদিকে, আব্রাহামিক ধর্মে ঈশ্বরের আদেশই নৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড, যা ইউথিফ্রো দিলেমার প্রথম দিকের প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত। 

এছাড়া, নাস্তিকদের জন্য, ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং নৈতিকতার বিষয়টি প্রাকৃতিক এবং মানবিক বিবর্তন থেকে উদ্ভূত বলে তারা বিশ্বাস করেন। তাই এই নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখানে আমরা নাস্তিকদের সঙ্গে সহমত।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds