প্রশ্নের মুখে ঈশ্বর এবং হিন্দু ধর্মের জন্মান্তর বাদ।


হিন্দু ধর্মের দার্শনিক ভিত্তি অত্যন্ত গভীর ও সুসংহত, যেখানে জন্ম, মৃত্যু, কর্মফল এবং আত্মার মুক্তি বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই ধর্মে ঈশ্বরকে সর্বব্যাপী এবং ন্যায়পরায়ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যিনি প্রতিটি জীবের কর্মফল অনুযায়ী তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। জন্মমৃত্যুর চক্র এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত দুঃখ-সুখের অভিজ্ঞতা জীবনের মূল উদ্দেশ্য—আত্মার শুদ্ধি এবং মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে। 

কিন্তু অনেক সময় জন্মের পরই শিশুর মৃত্যু, দারিদ্র্য, বা দুঃখ-যন্ত্রণা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে—এটি কি ঈশ্বরের ন্যায়, নাকি অন্য কোনো গভীর তত্ত্বের প্রতিফলন? এই বিষয়গুলো হিন্দু ধর্মের মূল দার্শনিক শিক্ষা এবং ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে বুঝতে সহায়তা করে।


1. হিন্দু ধর্মে এত দেবী-দেবতা রয়েছে। তারা কীভাবে একসঙ্গে একটি সৃষ্টিকর্তার অংশ হিসেবে কাজ করে?

আপনি জানতে চেয়েছেন, হিন্দু ধর্মে এত দেবী দেবতা রয়েছে তারা একসঙ্গে কিভাবে সৃষ্টি কর্তার অংশ হিসেবে কাজ করে। যেভাবে একজন মানুষ, তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ গুলোকে কাজে লাগিয়ে তার দেহের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। ঈশ্বর, যিনি জগতের সর্ব স্তরে বিদ্যমান রয়েছেন। দেবী দেবতারা দেবতারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই কাজগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে পালন করেন। 

2. হিন্দু ধর্মে "মোক্ষ" বা মুক্তির ধারণা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এটি কিভাবে অর্জন করা যায়?

আপনি হিন্দু ধর্মে মোক্ষ বা মুক্তির ধারণা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা জানি মানুষ ভালো কাজ করলে স্বর্গে যাবে, এবং খারাপ কাজ করলে নরকে। 

কিন্তু যে মানুষটা খারাপ কাজ করেছে, সে ভালো কাজও তো করেছে। আবার যে মানুষটা ভালো কাজ করেছে, সে তার জীবনে কোনো না কোনো খারাপ কাজও করেছে। তাই, তার ভালো কাজের জন্য তাকে স্বর্গে, এবং খারাপ কাজের জন্য নরকে, দুই জায়গাতে যাওয়া উচিত। এতে করে ভগবান বা ঈশ্বরের ন্যায়ের দিক ফুটে ওঠে। 

হিন্দুধর্ম স্বর্গ নরকের উর্ধ্বে ঈশ্বরের নিজের ধাম, যেখানে বসে তিনি স্বর্গ নরক এবং পৃথিবী বানিয়েছিলেন। সেই পরম ধাম বা মোক্ষ ধামে প্রবেশ করার কথা বলা হয়। যেখানে মানুষ, নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে মিশে যায়। যেভাবে এক ঘটি জলকে যদি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। সেই ঘটির জল সমুদ্রের জল হয়ে যায়। তাকে আর পুনরায় ঘটিতে ভরাট করা যায় না। সেভাবেই মুক্ত আত্মা মোক্ষ প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় জন্ম মৃত্যু, সুখ দুঃখের চক্রে আবর্তিত হয় না। 

হিন্দু ধর্ম বলছে, এই সুখ দুঃখ বা স্বর্গ নরক থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। এই জগতে যা কিছু অসার বা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। তাহাই মায়া। এই জ্ঞানকে ধারণ করে, অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি হলেই মোক্ষ প্রাপ্ত হওয়া যায়।

3. হিন্দু ধর্মে পুনর্জন্মের ধারণা রয়েছে। এটি কি মানুষকে ন্যায়ের শিক্ষা দেয় নাকি দুঃখের চক্রে আবদ্ধ করে রাখে?

প্রথমত আপনি বিচার করুন। একজন মানুষ যিনি জীবনে ঈশ্বরকে দেখতে পান না, পৃথিবীতে এত ধর্ম আছে, কে আসল কে নকল। কে কতটা আসল বা কতটা নকল, সেটাও সে জানতে পারে না। সে কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবে?

আবার মানুষ যে অপরাধপ্রবণ সেটাও সবাই জানে। তার সেই অপরাধ শোধরানোর জন্য, এক জন্ম যথেষ্ট না। সে ঈশ্বরের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে এবং পুনরায় অপরাধ করবে। এমন ব্যক্তি স্বর্গে গেলে স্বর্গকে নরকে পরিবর্তন করবে।

কিন্তু, প্রতিবার সে যখন নতুন জন্ম নেয়, তাকে নতুন একটি সুযোগ দেওয়া হয় এবং এই সুযোগ ততদিন পর্যন্ত চলতে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত সে মোক্ষ বা ঈশ্বর সাযুজ্য লাভ না করে। মনে রাখবেন আমাদের হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর স্বার্থপর নয়। তিনি মানুষকে এতটাই ন্যায় পরায়ণ এবং ভালোবাসেন, যে তিনি মানুষকে বারবার শুধরানোর সুযোগ দেন। "লিমিটেড অফার", "মাই ওয়ে ইজ দা হাইওয়ে" এ ধরনের ধারণা হিন্দু ধর্মে নেই। 

4. হিন্দু ধর্মে কর্মফলের ধারণা অনুযায়ী, যদি কেউ নিজের দোষে দারিদ্র্য বা দুঃখ পায়, তাহলে সাহায্য করার মাধ্যমে আমরা কি সেই কর্মফল নষ্ট করে দিচ্ছি? এটি কি ঈশ্বরের পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করা নয়?

না। এমনটি নয়। কর্ম করলে তার ফল অবশ্যই দেয়। আপনি, দরিদ্র পরিবারের ছেলের কথা বলেছেন। ইহাকে প্রারব্ধ বলা হয়। ছেলেটি তার পূর্ব জন্মের প্রারুব্ধ ভোগ করছে। গরিব ছেলেটি যদি নিজের সেই প্রারুব্ধ কে স্বীকার করে, নিজের জাগতিক সুখ বা ইচ্ছা ত্যাগ করে, প্রত্যেকটি কর্ম, ঈশ্বরের নিমিত্তকর্ম হিসেবে পালন করে। তবে সে নিশ্চয়ই। জন্ম ও মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি পাবে। একই ভাবে যে ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে সে সব ঐশ্বর্য এবং সুখকে ঈশ্বরের মনে করে নিরাকাঙ্খায় প্রত্যেকটি কর্ম, ঈশ্বরের নিমিত্তকর্ম হিসেবে পালন করে সেও মুক্তি পাবে। 

বিচার করে দেখুন, জগতে কে কদিন থাকে? কার মৃত্যু কিভাবে আছে কেউ বলতে পারেনা? আমরা কিছু নিয়ে আসিনি, কিছু নিয়ে যাব না। অর্থাৎ সবকিছু ঈশ্বরের। আমরা এখানে, তাঁর আদেশের অপেক্ষায় থাকি। এই সংসার তার, একে নিজের ভাবলেই, সুখ দুঃখ নিজের ওপর এসে পড়ে। তাই, এটি ঈশ্বরের পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করা নয়। বরং নিমিত্ত কর্ম করে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা।

5. হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, আত্মা অমর এবং এটি একটি দেহ থেকে আরেকটি দেহে স্থানান্তরিত হয়। যদি আত্মা একই থাকে, তাহলে পূর্বজন্মের স্মৃতি মানুষ ধরে রাখতে পারে না কেন? এটি কি আত্মার শিক্ষার পথে একটি বাধা?

পূর্বজন্মের স্মৃতি মানুষ ধরে রাখতে পারে না এর অনেক কারণ আছে। ধরুন এই জন্মে যে আপনার শত্রু, পরের জন্মে সে আপনার পিতা হয়ে জন্মালো। যে এ জন্মে আপনাকে দুঃখ দিয়েছে, পরের জন্মে সে আপনাকে লালন পালন করবে। এতে করে অজান্তেই তার কর্মে, খারাপ কর্মগুলো বাদ পড়ে ভালো কর্মযোগ হবে। 

আবার এমন টাও নয় যে পূর্বজন্মের স্মৃতিগুলো পরের জন্মে সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়ে যায়। যোগের দ্বারা পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধার করা সম্ভব। যোগ সূত্রের বিভূতি পাদে এর উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও এরকম অনেক উদাহরণ আছে যারা পূর্ব জন্মের স্মৃতি খুঁজে পেয়েছে এবং তাদের পূর্বজন্মের পরিবার, বন্ধু, ঘটনা এমনকি কিভাবে মৃত্যু হয়ে যায় হুবহু ব্যাখ্যা করেছে। তাই সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। 

হিন্দুধর্মে কর্মফলের ধারণা অনুযায়ী, যদি কেউ নিজের দোষে দারিদ্র্য বা দুঃখ পায়, তাহলে সাহায্য করার মাধ্যমে আমরা কি সেই কর্মফলকে নষ্ট করে দিচ্ছি? এই কাজ কি ঈশ্বরের পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করা নয়?

না। আমরা কিছুই করি না। আগেই বলেছি, আমরা ঈশ্বরের আদেশের অপেক্ষায় আছি। দরিদ্রকে সাহায্য করলে তার কর্মফল কে আমরা নষ্ট করি না। ঈশ্বর আমার মধ্যেও আছে। ওই দরিদ্রদের মধ্যেও আছে। একই ঈশ্বর, আমার চোখ দিয়ে ওই দরিদ্রকে দেখছে। ওই দরিদ্রের চোখ দিয়ে আমাকে দেখছে।  

আমার পিতা মাতা এই দেহকে একটি নাম দিয়েছে। যেটা আমার পরিচয় হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আসলে এই দেহ, নই, আমি মন নই, আমি চেতনা নই, কারণ এই মন এবং চেতনা আমার। যেভাবে আমরা বলি— এই কাপড় আমার, এই চোখ, হাত, পা আমার। আমি, কাপড় নই, চোখ-হাত-পা কিছুই আমি নই। আমি হলাম সে যা সকলের মধ্যে এক। 

আমি, আমার, আমাদের— এইসব ধারণা আমাদের মিথ্যা অহংকার। তাই আমি কিছুই করি না। যদি আমার মনে কৃপা জন্মায়, তবে সেটাও ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা মাত্র। দরিদ্রকে সাহায্য করার মাধ্যমে ঈশ্বর ওই দরিদ্রের চোখ দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করছেন যে, আমি নিজের আমিত্ব বা মমত্ব কতটা ত্যাগ করে, দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছি। এবং আমার দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে সেই দরিদ্রকে ঈশ্বরই সেবা করছেন। আমি কিছুই করছি না।

হিন্দু ধর্মে বলা হয়, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এবং তিনি নিরপেক্ষ। তবে যদি ঈশ্বর সত্যিই নিরপেক্ষ হন, তাহলে তিনি কেন একজনকে ধনী এবং অন্যজনকে দরিদ্র পরিবারে জন্ম দেন? এটি কি ঈশ্বরের পক্ষপাতিত্ব নয়?

ঈশ্বর ন্যায়ের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ। ফল প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ। তিনি একজনকে ধনী এবং অন্যজনকে দরিদ্র পরিবারে জন্ম দেন তাঁদের কর্মের ভিত্তিতে? এটি ঈশ্বরের পক্ষপাতিত্ব নয়, এটি তাঁর ন্যায়।  

ঈশ্বর ন্যায়ের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ। ফল প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ। তিনি একজনকে ধনী এবং অন্যজনকে দরিদ্র পরিবারে জন্ম দেন তাঁদের কর্মের ভিত্তিতে? এটি ঈশ্বরের পক্ষপাতিত্ব নয়, এটি তাঁর ন্যায়। 

আপনি বলছেন হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর কর্মফল অনুযায়ী ধনী বা দরিদ্র পরিবারে জন্ম দেন। তাহলে, একটি শিশু যে জন্মেই মারা যায় বা একটি শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়, সেটি কি তার পূর্বজন্মের পাপের শাস্তি? যদি এটি তার কর্মফল হয়, তবে একটি নিষ্পাপ শিশুকে এমন শাস্তি দেওয়া ঈশ্বরের ন্যায় কি সঠিক বলে মনে হয়।

শিশু তার প্ররাব্ধ ফল ভোগ করছে। সে যদি জন্মের পর মৃত্যু বরণ করে তবে সে নিষ্পাপ হওয়ার দরুন মুক্তি পেয়ে যাবে। তার কর্ম ও কর্ম ফলের এখানেই চক্র শেষ। তাই সে ঈশ্বরের ধামে চলে গেছে।

আপনি বলছেন, বন্ধন থাকলে তবেই মুক্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি একজন শিশু তার জন্মের পরই মারা যায় এবং তার সব পাপের শোধ হয়ে যায়, তবে সে কীভাবে ভোগ (ভোগের মাধ্যমেই বন্ধন কাটে) বা আত্মশুদ্ধি করতে পারল? যদি তার মুক্তি নিশ্চিত হয়, তাহলে এই যাত্রার উদ্দেশ্য কি? এই ভোগ না করেই তাকে মুক্তি দেওয়া যায় না কি?

ভরাট কলসিকে খালি করা যায়, কারো বন্ধন থাকলে তবেই তাকে মুক্ত করা যায়। আর যদি জন্ম না দিয়েই মুক্তি সম্ভব হতো। তাহলে তো এই জীবনে কোনো অর্থই ছিলো না।

হিন্দু ধর্মে জন্ম-মৃত্যু এবং কর্মফলের ধারণা ঈশ্বরের ন্যায় এবং করুণার প্রতিফলন। শিশু জন্মের পরই মারা গেলে তা তার পূর্বজন্মের প্রারব্ধ কর্মের ফল। যদি তার কর্মফলের চক্র শেষ হয়ে যায়, তবে সে মুক্তি পেয়ে ঈশ্বরের ধামে স্থান পায়। জন্ম-মৃত্যুর চক্র আত্মার শুদ্ধি এবং জ্ঞানলাভের মাধ্যম। তবে যদি পূর্বজন্মের ঋণ শেষ হয়, তাহলে ভোগের প্রয়োজন হয় না। এভাবেই ঈশ্বর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জীবের মুক্তির পথ নির্ধারণ করেন।।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds