নিজস্ব সংবদদাতা: আজ পুনরায় চালু হলো হাজার বছরের হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে একটা পূর্ণাঙ্গ লাইব্রেরি ও ছাত্রাবাস সহ ২০,০০০ শিক্ষার্থীর পাঠদানের ব্যবস্থা ছিলো। ৪৩০ খ্রিস্টাব্দ প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১৯২ সালে তুর্কী আক্রমণে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় এবং পাঠাগারে সংরক্ষিত প্রায় ৯০,০০০ পুথি পুড়ে যায়। বখতিয়ার খিলজীর আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো।
প্রচলিত আছে একাদশ শতকে (১০৮৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইটালির "University of Bologna" পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু তারও প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে তথা ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছিল।
প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের ইতিহাস: জ্ঞানের অমর আলোকস্তম্ভ
প্রাচীন নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারতের বিহার রাজ্যের রাজগিরে অবস্থিত একটি মহান শিক্ষাকেন্দ্র, যা খ্রিস্টীয় ৫ম শতক থেকে ১৩শ শতক পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিল। এটি শুধুমাত্র একটি মঠ নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানের বিভিন্ন ধারা মিলিত হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ: গুপ্ত যুগের উত্থান
নালন্দা মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে, প্রায় খ্রিস্টীয় ৪২৭ সালে। সম্রাট কুমারগুপ্ত প্রথম বা তার উত্তরসূরীদের দ্বারা এটি স্থাপিত হয় বলে মনে করা হয়। সেই যুগে ভারতীয় জ্ঞানব্যবস্থা তিনটি মৌলিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল: বৌদ্ধ দর্শন, বৈদিক-হিন্দু তত্ত্বচর্চা এবং অনুশাসিত যুক্তিবিদ্যা ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। নালন্দা এই তিন ধারাকে একত্রিত করে বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রতিষ্ঠার পর এটি দ্রুত বিকশিত হয়। হর্ষবর্ধন এবং পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা তার শীর্ষে পৌঁছে। এখানে পড়ানো হতো বেদ, উপনিষদ, আয়ুর্বেদ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন এবং ভাষাবিজ্ঞান। বিখ্যাত আচার্যরা যেমন নাগার্জুন, আর্যদেব, ধর্মকীর্তি এবং শীলভদ্র এখানে শিক্ষা দিয়েছেন। নালন্দার গ্রন্থাগারগুলো, বিশেষ করে 'ধর্মগঞ্জ' নামক সাত তলা গ্রন্থাগার, লক্ষ লক্ষ পুঁথি সংরক্ষণ করত। এটি ছিল জ্ঞানের এক অপার ভান্ডার, যা বিশ্বের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনীয় নয়।
ছাত্র-শিক্ষকের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র: বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ
নালন্দা ছিল একটি সত্যিকারের গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি। এখানে ১০,০০০ এরও বেশি ছাত্র এবং ২,০০০ শিক্ষক ছিলেন। চীন, কোরিয়া, জাপান, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং এমনকি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা আসতেন।চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং (খ্রিস্টীয় ৬৩০ সাল) এবং ইৎসিং তাদের ভ্রমণবৃত্তান্তে নালন্দার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। হিউয়েন সাং লিখেছেন যে নালন্দায় প্রবেশপরীক্ষা ছিল অত্যন্ত কঠিন—শুধুমাত্র ২০-৩০% ছাত্রই উত্তীর্ণ হতেন।
বিদেশী নথিতে নালন্দাকে 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড', 'মহাবিদ্যার বন' এবং 'বুদ্ধধর্মের আলোকশিখা' বলা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র বৌদ্ধ শিক্ষা নয়, হিন্দু দর্শন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানেরও কেন্দ্র ছিল। নালন্দার প্রভাব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যা বৌদ্ধধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, তিব্বতী গুরু পদ্মসম্ভব এবং শান্তরক্ষিত নালন্দা থেকে শিক্ষা নিয়ে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন।
ধ্বংসের ট্র্যাজেডি: একটি সভ্যতার অন্ধকার অধ্যায়
দুর্ভাগ্যবশত, ১১৯৩ সালে তুর্কি আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজি নালন্দা ধ্বংস করে। গ্রন্থাগারের আগুন তিন মাস ধরে জ্বলেছিল, যা বিদেশী নথিতে উল্লেখিত। এই ধ্বংস শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, ভারতীয় জ্ঞান-ঐতিহ্যের একটি বড় ক্ষতি ছিল। লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ নষ্ট হয়, যা বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে চিরকালের জন্য দরিদ্র করে। এই ঘটনা বৌদ্ধধর্মের ভারতে হ্রাসেরও একটি কারণ। তবে নালন্দার আত্মা অমর—এর ধ্বংসাবশেষ আজও ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে সংরক্ষিত।
আধুনিক নালন্দার পুনর্জন্ম: একটি নতুন যুগের সূচনা
প্রাচীন নালন্দার ধ্বংসের পর শতাব্দী ধরে এটি ভুলে যাওয়া হয়নি। ২০শ শতাব্দীতে এর পুনর্জন্মের উদ্যোগ শুরু হয়, যা আধুনিক ভারতের সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধারের একটি মাইলফলক।
আন্তর্জাতিক সমর্থনে পুনর্গঠন: একটি গ্লোবাল উদ্যোগ
২০০০ দশকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে. আবদুল কালাম নালন্দার পুনর্জাগরণের প্রস্তাব করেন। পূর্ব এশিয়া সমিটের ১৮টি দেশ, যেমন চীন, জাপান, থাইল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া, এতে সমর্থন করে। ২০১০ সালে ভারতীয় সংসদে 'নালন্দা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট' পাস হয়, যা এর আইনগত জন্ম দেয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হয়, যাতে হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সাথে মিলিত করা হয়।
শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা এবং সাম্প্রতিক উন্নয়ন
২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রাথমিক স্কুলগুলো: স্কুল অফ হিস্টরিকাল স্টাডিজ, স্কুল অফ ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ, স্কুল অফ বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ, ফিলোসফি অ্যান্ড কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন। ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদী ৪৫৫ একরের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন করেন, যা নেট জিরো (জিরো এমিশন) ক্যাম্পাস—সোলার এনার্জি, রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং জিরো ওয়েস্ট সিস্টেম সহ।
২০২৫ সালে, নালন্দা ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ যোগা উদযাপন করে 'যোগা ফর ওয়ান আর্থ, ওয়ান হেল্থ' থিমে। এটি আন্তর্জাতিক ছাত্রদের আকর্ষণ করছে, যা ভারতকে এশিয়ার শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। ক্যাম্পাসে বিশ্বমানের লাইব্রেরি, লেক, উদ্যান এবং হোস্টেল রয়েছে, যা প্রাচীন স্থাপত্য অনুসরণ করে নির্মিত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অবদান: একটি দৃষ্টিভঙ্গির ফল
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নালন্দার পুনর্জন্মকে ভারতের 'গোল্ডেন এজ' এর সূচনা হিসেবে দেখেন।
সাংস্কৃতিক-কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি: ভারতের বিশ্বমঞ্চে পুনরুত্থান
মোদী নালন্দাকে চারটি মূল ভাবনায় তুলে ধরেন: ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন, হিন্দু-বৌদ্ধ জ্ঞানসম্পদের বিশ্বমঞ্চে প্রত্যাবর্তন, ভারতকে এশিয়ার শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বৌদ্ধিক কূটনীতি। তাঁর নেতৃত্বে নালন্দা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় করে, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়া দেশগুলোর সাথে। উদাহরণস্বরূপ, ১৭টি দেশের অ্যাম্বাসেডররা ২০২৪ এর উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন।
নতুন ক্যাম্পাসের নির্মাণ ও উদ্বোধন: একটি টেকসই মডেল
২০২৪ সালের জুনে মোদী নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন করেন।এটি ₹২০০০ কোটি টাকায় নির্মিত, যা কংগ্রেসের ₹২০ কোটির তুলনায় অনেক বেশি। ক্যাম্পাসটি পরিবেশবান্ধব—সোলার পাওয়ার, ওয়াটার কনজারভেশন এবং প্রাচীন নালন্দার স্থাপত্য অনুসরণ করে। মোদী এটিকে 'ভারতের জ্ঞান-ঐতিহ্যের আধুনিক প্রতীক' বলেন।
তাঁর অবদানে নালন্দা বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করছে, যা রিপাবলিক ডে প্যারেড ২০২৫ এ প্রদর্শিত হবে।
নালন্দার হিন্দু-বৌদ্ধ পরিচয়: আন্তর্জাতিক নথিতে
নালন্দা কেবল বৌদ্ধ মঠ নয়, হিন্দু-বৌদ্ধ মিশ্র জ্ঞানকেন্দ্র।
চীনা নথিতে: একটি মিশ্র দর্শনের কেন্দ্র
হিউয়েন সাং লিখেছেন যে নালন্দায় বেদ-উপনিষদ, আয়ুর্বেদ এবং যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হতো। এটি বৌদ্ধ দর্শনের সর্বোচ্চ কেন্দ্র ছিল, কিন্তু হিন্দু তত্ত্বও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তিব্বতী নথিতে: তন্ত্র-দর্শনের মিলনস্থল
'দেব-থের স্ঙ্গোন-পো' তে নালন্দাকে শান্তরক্ষিত এবং পদ্মসম্ভবের জন্মস্থান বলা হয়। এটি হিন্দু-বৌদ্ধ তন্ত্রের মিলনস্থল।
জাপান ও কোরিয়ার নথিতে: আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়
এগুলোতে নালন্দাকে বৌদ্ধধর্মের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র বলা হয়, কিন্তু সংস্কৃত এবং হিন্দু গ্রন্থপাঠের উল্লেখ রয়েছে।
আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ও ভর্তি-প্রক্রিয়া
কোর্সের বিবরণ: আধুনিক এবং ঐতিহ্যবাহী মিশ্রণ
নালন্দায় এমএ/এমএসসি ইন বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ, হিস্টরিকাল স্টাডিজ, ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ; পিএইচডি প্রোগ্রাম; সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। এগুলো সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এবং কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন ফোকাস করে।
ভর্তি-প্রক্রিয়া: আন্তর্জাতিক মান
অনলাইন আবেদন, ব্যাচেলর ডিগ্রি সাথে ৫৫% নম্বর, স্টেটমেন্ট অফ পারপাস এবং ইন্টারভিউ। আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য আলাদা কোটা।
নালন্দার প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ: শান্তি ও জ্ঞানের কেন্দ্র
নালন্দা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করছে, বিহারকে গ্লোবাল হাব করে। ভবিষ্যতে এটি এআই এবং সাসটেইনেবিলিটি রিসার্চে নেতৃত্ব দেবে।
উপসংহার:
নালন্দার পুনর্জন্ম ভারতের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। মোদীর উদ্যোগে এটি জ্ঞান, শান্তি এবং ধার্মিক-দর্শনের কেন্দ্র হয়ে উঠছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন