বেদ কত পুরাতন? ইহা কে রচনা করেছে ? How old are the Vedas? Who wrote it?
বেদ কত পুরাতন জানার আগে জানান দরকার বেদ কি? বেদ কি কোনো ধর্ম গ্রন্থ, নাকি কোনো? বেদ জ্ঞানের একটি মুখ্য অবয়ব এবং একটি প্রক্রিয়া উভয়ই। এটি একদিকে যেমন তথ্যের একটি বিশাল ভাণ্ডার, তেমনি অন্যদিকে একটি ক্রমাগত অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া। বেদ কখনও কখনও পাঠ্যপুস্ত এবং স্থির তথ্যের সংগ্রহের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদ এর চেয়ে অনেক বেশি।
বেদ কি ?
সংস্কৃত 'বিদ্' ধাতু থেকে উৎপন্ন বেদ শব্দের অর্থ হলো জ্ঞান। এই জ্ঞান বা বিদ দুই প্রকার: পরা বিদ্যা বা পরা জ্ঞান, এবং অপরা বিদ্যা বা অপরা জ্ঞান। যা জানলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না অর্থাৎ চূড়ান্ত সত্যের সাথে সম্পর্কিত উচ্চতর শিক্ষা বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞান হয়। তাকে বলা হয় পরা বিদ্যা অপরাবিদ্যা হল জগতের জ্ঞান। মানুষ আত্মজ্ঞান, বোধশক্তি এবং স্ব-সচেতনতার আশীর্বাদপুষ্ট, যা বিভিন্ন দার্শনিক ও যৌক্তিক ক্ষেত্রের সাথে জড়িত। বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ইত্যাদি অপরা বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
আত্মজ্ঞান বলতে নিজের প্রকৃতি, চরিত্র, ক্ষমতা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতনতা এবং বোঝাপড়া বোঝায়। এই ক্ষমতাটি অন্তঃদর্শন এবং প্রতিফলনের সাথে জড়িত, যা ব্যক্তিদের তাদের অন্তরজগতকে বোঝার সুযোগ দেয়।
মেটাফিজিক্স হল দর্শনের একটি শাখা যা বাস্তবতা, অস্তিত্ব এবং মহাবিশ্বের মৌলিক প্রকৃতি অন্বেষণ করে। এটি যা বিদ্যমান এবং সত্তার প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আত্মজ্ঞান-এর প্রেক্ষাপটে, অধিবিদ্যা ( বা Metaphysics) আত্মার সারাংশ, চেতনতা এবং মন ও শরীরের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। এটি পরিচয়, অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকৃতি নিয়ে অনুসন্ধান করে।
মেটাফিজিক্সের উৎপত্তি এবং এর অর্থ
৪র্থ শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা তিনি বিভিন্নভাবে "প্রথম দর্শন," "প্রথম বিজ্ঞান," "জ্ঞান," এবং "থিওলজি" হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে, তার কাজের একজন সম্পাদক এই গ্রন্থকে "টা মেটা টা ফিজিকা" নামে অভিহিত করেন, যার অর্থ প্রায় "প্রকৃতির সম্পর্কে গ্রন্থগুলির পরে থাকা গ্রন্থগুলো : "ফিজিকা" এবং "মেটা ফিজিকা".
"ফিজিকা": অ্যারিস্টটলের সেই গ্রন্থগুলি, যা আজকের দিনে "Physics" নামে পরিচিত, প্রকৃতির এবং প্রাকৃতিক জগতের উপর তার অন্যান্য লেখাগুলি অন্তর্ভুক্ত। তবে এটি আধুনিক কালে যাকে আমরা "ফিজিক্স" বলি, সেই পরিমাণগত বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং এটি সংবেদনশীল এবং পরিবর্তনশীল (অর্থাৎ, শারীরিক) বস্তুগুলির সম্পর্কিত দার্শনিক সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করে।
"মেটা ফিজিকা": "টা মেটা টা ফিজিকা" শিরোনামটি সম্ভবত এই ধারণা প্রকাশ করে যে, অ্যারিস্টটলের দর্শনের ছাত্রদের "ফিজিকা" আয়ত্ত করার পরেই "প্রথম দর্শন" বা "মেটাফিজিক্স" নিয়ে তাদের অধ্যয়ন শুরু করা উচিত। ল্যাটিন একক বিশেষ্য "মেটাফিজিকা" গ্রিক শিরোনাম থেকে উদ্ভূত হয় এবং অ্যারিস্টটলের গ্রন্থের শিরোনাম ও বিষয়বস্তুর নাম উভয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
মেটাফিজিক্স শব্দের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
"মেটাফিজিকা" থেকেই পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব ভাষায় মেটাফিজিক্স শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যেমন ইংরেজিতে "metaphysics", ফরাসিতে "la métaphysique", এবং জার্মানে "die Metaphysik"। বেদ এই উভয় প্রকার- পরা বিদ্যা, অপরা বিদ্যা এবং অধিবিদ্যা (বা Metaphysics) -এর তথ্যের সংগ্রহ।
বেদ কত পুরাতন?
বেদ কত পুরাতন, এ নিয়ে নানা মতামত প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে আছে। কারণ বেদ মৌখিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রচারিত হয়েছে বহু শতাব্দী ধরে। এই বেদকে এ পৌরুষেয় বলা হয়। অর্থাৎ, ইহা কেউ রচনা করেননি। বেদ কোন ব্যক্তির রচনা নয়। ঋষিরা যে সত্যকে দর্শন করেছিলেন। সেই তত্ত্বকে যুগ যুগ ধরে সাধনা ও প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন তত্ত্ব দ্রষ্টা ঋষিদের কাছে এই মন্ত্র গুলি প্রকাশ হয়েছে। সেই মন্ত্রসমূহ নানা ভাবে ছড়ানো ছিল। মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস এই ছড়ানো ছিটানো মন্ত্রগুলো সংগ্রহ করে, কিছু শৃঙ্খলিত করে চার ভাগে বিভক্ত করেন, যথা –
- ঋগ্বেদ
- সামবেদ
- যজুর্বেদ
- অথর্ববেদ
মহর্ষি ব্যাস তাঁর চার শিষ্যকে চার বেদ শিক্ষা দেন:
- পৈলকে ঋগ্বেদ
- বৈশম্প্যায়নকে যজুর্বেদ
- জৈমিনিকে সামবেদ
- সুমন্তকে অথর্ববেদ
তবে, প্রাচীন ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে, বেদের রচনা কালকে নিম্নরূপে নির্ধারণ করা যেতে পারে:
বেদের প্রাচীনত্ব:
-
ঋগ্বেদ: বেদের মধ্যে প্রাচীনতম ঋগ্বেদ, যার প্রাপ্ত মেনুস্ক্রিপ্ট প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এটি আরও প্রাচীন হতে পারে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-৩০০০ সালের মধ্যে।
-
সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ: ঋগ্বেদের পরবর্তী সময়ে রচিত অন্যান্য বেদগুলির মধ্যে সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ অন্তর্ভুক্ত। এই বেদগুলি প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-৮০০ সালের মধ্যে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
গবেষণার ভিত্তিতে ধারণা:
- ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: বেদগুলি প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত, যা প্রাচীনতম ভারতীয় ভাষার একটি রূপ।
- পুরাতাত্ত্বিক তথ্য: কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ যেমন হরপ্পা সভ্যতা এবং বৈদিক সভ্যতার মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতে বেদগুলির প্রাচীনত্ব অনুমান করা হয়।
- মৌখিক ঐতিহ্য: বেদগুলি বহু শতাব্দী ধরে মৌখিকভাবে সংরক্ষিত ছিল এবং পরে লিখিত রূপে সংকলিত হয়েছে, যা তাদের ইতিহাসকে আরও প্রাচীন করে তোলে।
বেদশাস্ত্র গুলি প্রায় ৩৫০০-৪০০০ বছরের পুরাতন বলে অনুমান করা হয়, যা প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
0 Comments: