ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী রাহু, কেতু ও গ্রহণ
কোনো কিছুর অর্থ যথাযথ বুঝতে হলে তার পেছনের যুক্তি সঙ্গত কারণ গুলো অবশ্যই জানতে হবে। হিন্দু ধর্মের জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে রাহু বা কেতুর অবস্থান সম্পর্কে যে ধ্যাণ ধারনা আছে সেগুলোকে নিয়ে কিছু অজ্ঞ মানুষ ঠাট্টা করে।
প্রসঙ্গত একটি নাস্তিক ওয়েবসাইট এই সম্পর্কে নিজের বক্তব্য রেখে বলেছেন, "যারা মোটামুটি প্রাইমারি শিক্ষাও পেয়েছেন, উনারাও রাহু গ্রহের কথা শুনে এবং চাঁদ এবং সূর্যের মাঝে রাহুর কক্ষপথ আছে শুনে হেসে মরে যাবেন।" — এছাড়া তারা অন্যান্য অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা ভক্তি বেদান্ত স্বামী প্রভুপাদকে অপদার্থ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন।
fig: 01 Rahu and Ketu |
ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি অতি প্রাচীন। তাই, গ্রহের চাল চলনের ধারনা গুলো প্রাচীণ Geocentric বা ভূকেন্দ্রিক মডেলের ওপর নির্ভর করেই নির্ণীত ছিলো। মনে করা হতো পৃথিবী স্থির এবং সূর্য নক্ষত্র গুলো পৃথিবীতে আবর্তন করছে। কিন্তু তা বলে একে অবৈজ্ঞানিক বলা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ ভূকেন্দ্রিক মডেলের উপর নির্ভর করে তখন গণনা করা হতো এবং স্থান-কাল সময় নির্ণয় করা হত।
সূর্যকেন্দ্রিক বা heliocentric model আধুনিক যুগের আবিষ্কার। যেখানে বলা হয়েছে সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহ নক্ষত্র গুলো নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে ঘুরতে আবর্তন করে চলছে। কিন্তূ রাহু বা কেতুর কোনো উল্লেখ অধুনিক মডেলে নেই। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র ও জ্যোতি শাস্ত্রে এর কি ব্যখ্যা আছে?
রাহু ও কেতুর অবস্থান:
নয়টি গৃহের উল্লেখ আমাদের হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে পাওয়া যায়। এরা যথাক্রমে:— রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু এবং কেতু।
রাহু বা কেতু হলো সূর্য ও চন্দ্রের কক্ষপথে মিলিত হওয়া দুটি বিন্দু Fig: 01। এদের কোনো ফিজিক্যাল অস্তিত্ব নেই। তাই, এদের ছায়া গ্রহ বলা হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে হিন্দু পঞ্জিকায় জ্যোতিষ-শাস্ত্রীর দ্বারা নির্ণীত দিনেই সূর্য গ্রহন চন্দ্র গ্রহন হয়ে আসছে। এই সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ দেখে কোন হিন্দু ভয় পান না। চাঁদ বা সূর্যকে রাহু গ্রাস করে ফেলছে বলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজের ভয় প্রকাশ করে না।
এই গ্রহণের সময় হিন্দুরা যেটা করে, সেটি হল। গ্রহনের সংক্রমণ কাল থেকে নিষ্ক্রমণকাল পর্যন্ত তারা কোন খাবার খায় না। গ্রহণ শেষ হলে স্নান করে তারপরে খাবার খায়। এই গ্রহনের সময়কে মন্ত্র সিদ্ধির উত্তম স্থান হিসেবেও অনেক বলা হয়েছে।
গ্রহণের সময় কেন খাওয়ার খেতে নেই?
গ্রহণের সময় কি ঘটে এটা জানলেই এর উত্তর দেওয়া সম্ভব হবে।
অনেকে বলে এই সময়ে জীবাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়। এসব ফালতু কথা। বাজারে বিক্রি হওয়া জাদু টোটকার চটি বইগুলোতে এই ধরনের উদ্ভাট অশাস্ত্রীয় কথা লেখা থাকে। শাস্ত্র এবং প্রত্যক্ষ জ্ঞান অন্য কথাই বলে।
গ্রহণের সময় সূর্য চন্দ্র এবং পৃথিবী একই সরলরেখায় চলে আসে। এই সময় সূর্য এবং চাঁদের মধ্যাকর্ষণ বলের ফলে পৃথিবীতে থাকা সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে। এই ঘটনাকে জোয়ার বলে। আর যে জায়গাগুলোতে জল কমে যায় তাকে ভাটা বলে।
সমুদ্র বিশাল জল ধারায় বিশাল পরিবর্তন হয় বলেই এই আকর্ষণ বল কে প্রত্যক্ষ করা যায়। সামান্য পুকুর বা নদী নালায় এই প্রভাব অনুভব করা যায় না। আমাদের দেহের মধ্যে যে রস আছে। চন্দ্রের আকর্ষণ সেই রসকে টেনে ওপরে ওঠে। তখন অনেকের (মূলত যাদের গাট বাত, ইউরিক অ্যাসিড আছে) তাঁদের শরীরে বেদনা হয়। এটা প্রত্যক্ষ। কোনো গবেষক বা বিজ্ঞানীর ভ্যালিডেশন দরকার নেই। হিন্দু, মুসলীম, খ্রিষ্টান, নাস্তিক সকলের এই ব্যাথা হয়। কেন হয়?
অস্থি সন্ধিতে ব্যথার একটি কারণ রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া। গ্রহণের সময়ও একই ঘটনা ঘটে। উক্ত সময়ে যে পিত্তরস ও দেহ রাস গুলো বিক্রিয়া ঘটে। তার প্রভাব মিলিতভাবে সারা শরীরে পড়ে। আয়ুর্বেদ মতে এ বাত-পিত্ত-কফ এই ত্রি-দোষের কারণেই শরীরে ব্যথা বেদনা ক্লেশ হয়। সেই সব থেকে শরীরকে নীরোগ রাখার জন্য গ্রহণের সময় খাওয়ার খেতে নেই। এতে করে রোগ জন্মায় বা আয়ু হ্রাস হয়।
বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এসব মানে না। তাদের আমরা বাধাও দেব না। তারা তাদের মত চলুক। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।
রাহু কেতুু সূর্য চন্দ্র এরা কোন গ্রহ নয়।
যদিও আমরা বিজ্ঞানের বইয়ে সূর্যকে নক্ষত্র বলে জেনেছি। চন্দ্রকে উপগ্রহ বলে জেনেছি। রাহু ও কেতুর কোনো নাম আধুনিক বিজ্ঞান বইয়ে নেই। এই চন্দ্র, রাহু, কেতুর নামের বদলে ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো এই তিনটি গ্রহপিন্ড কে গ্রহ বলে জেনেছি। এছাড়া বহুত শুক্র পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি গ্রহের নাম আমরা আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মারফত জেনেছি।
সংস্কৃত শব্দ ‘গ্রহ’ বা ‘গ্রহন’ এই শব্দের এক্ষেত্রে ব্যাপার টা তেমন নয়। কখন আমরা বলি সূর্য গ্রহন বা চন্দ্র গ্রহণ। সেই ক্ষেত্রে সূর্যকে বা চন্দ্রকে উক্ত ছায়া গহ গুলো গ্রাস করছে, বা অধিকার করছে বলে মনে করা হয়। তাই এই নব গ্রহ যথা — রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু এবং কেতু এরা প্ল্যানেট অর্থে নয়। গ্রাহ্য কক্ষ বা ঘর রূপে ধরা হয়েছে।
তাই ‘গ্রহ’, বা ‘গ্রহন’ এই শব্দ গুলো যথাক্রমে প্ল্যানেট ও এক্লিপস (eclipse) অনুবাদ করলে ভুল অনুবাদ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো,
এখানে বিজ্ঞানসম্মত দিক কোথায়?
এর বিজ্ঞানসম্মত দিকটি হলো গননা। আমরা দিনের বেলায় আকাশের দিকে তাকাই। উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে আমরা সূর্যকে দেখতে পাই। সূর্য উদয় হলে তাহাকে দিন বা ‘দিবা’ এবং সূর্য অস্ত গেলে ‘রাত্রি’ বলা হয়। দিন এবং রাতকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই প্রতিটি ভাগ কে বলা হয় প্রহর। মোট আটটি প্রহর মিলে হয় এক দিবারাত্র। প্রতিটি প্রহরের নাম:— নিশীথ, প্রত্যূষ, প্রভাত, পূর্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ন, সায়াহ্ন, ও প্রদোষ।
প্রতিটি প্রহরে তিনটি যম থাকে। অর্থাৎ দিবা ভাগে ৩×৪=১২ টি যম এবং রাত্রে ১২ টি যম। মোট ২৪ টি যম। বর্তমানে এই জনসংখ্যাকেই ঘন্টা বলা হয়। প্রতিটি যমের অর্ধ ভাগ যমার্ধ রূপে পরিচিত।
রাতের বেলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা চাঁদ দেখতে পাই। প্রতি ১৫ দিনে এক পক্ষ হয়। এই ভবেই ৩০ দিনে এক মাস। রাতের বেলায় আকাশে চাঁদ ছাড়াও নক্ষুত্র দেখা যায়।
হিন্দু শাস্ত্র মতে মোট ২৭ টি নক্ষত্র রয়েছে। প্রতিটি নক্ষত্রদের চারটি পদ বা ঘর রয়েছে। এক একটি পদের পরিমাপ 3°20' করে করা হয়েছে। অতএব, 12°20' করে চন্দ্র একটি নক্ষত্রে বাস করে।
চন্দ্র ওই নক্ষত্রর যে পদ যায় সেই অনুসারে রাশির অংশ ভোগ করে। মেষ, বৃষ, এভাবে মোট বারোটি রাশি ভাগ করা হয়েছে।
এই সব কিছুই গননার অংশ। এই গননার দ্বারা রাহু বা কেতুর যে সময় ধরে ভোগ করে বা গ্রাস করে সেটাই গ্রহনকাল বলা হয়।
বারের নাম:
এই প্রহর , রাশি, নির্ণয় করার জন্য যে যন্ত্র ব্যাবহার করা তার নাম কোনার্ক মন্দিরের সূর্য ঘড়ি, বিষ্ণু স্তম্ভ, চন্দ্র স্তম্ভ (বর্তমানের কুতুব মিনার ও লৌহ স্তম্ভ নামে পরিচিত), এরকম বহু যন্ত্র ব্যাবহার করা হতো। দিল্লির যন্তর-মন্তর যারা ঘুরে এসেছেন তাঁদের আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জ্যোতিষ শাস্ত্রে আমাদের জীবনে কি ভূমিকা ছিলো।
হিন্দু ভূগোল, খগোল ভূকেন্দ্রিক ধারনার ওপর প্রতিষ্টিত হলেও এর মধ্যে বিজ্ঞান ছিলো না, এমন বলার কোনো অর্থ নেই।
রবি, চ্ন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি এগুলো যথাক্রমে বারের নাম। একই ভাবে Sunday, Monday, Tuesday, Wednesday, Thursday Friday, Saturday ইংরেজী বারের নাম। এবং অদ্ভুত ভাবে এরা প্রায় একই গ্রহ দেবতার নামে আছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই বারের নাম গুলো কোথা থেকে এলো? আসুন আজ জেনে নিন। এগুলো আসলে হোরার গননা থেকে এসেছে। দিনের আরম্ভে ক্ষিতিজ রেখায় যে গ্রহ অবস্থান করে, সেই গ্রহের নাম অনুযায়ী ওই দিনের নাম হয়।
উপরের চিত্রটি দেখুন: ক খ গ ঘ উ এই Row বরাবর বারের নাম লেখা হয়েছে। এবার নীচের চিত্রটি দেখুন এখানেও বারের নাম গুলো একটি বিশেষ নিয়মে লেখা হয়েছে।
সকাল 6-7 টা পর্যন্ত খিতিজ সূর্য বা রবির ভাগ ভোগ করে, এভাবে ভোর 5-6 টা পর্যন্ত বুধ ভোগ করে। রবি > শুক্র> বুধ> সোম> শনি> বৃহস্পতি> মঙ্গল > রবি >...শুক্র> বুধ> এভাবে 24 টি মান ভোগের পর পরের দিন সকালে 6 টায় ‘সোম’ এ এসে হাজির হয়। এভাবেই দিনের নাম গুলো নির্ণয় করা হয়।
এটি একটি প্যাটার্ন ফলো করে। তাই এটার একটি বৈজ্ঞানীক ভিত্তি ছিল, আছে।
পৌরাণিক কাহিনী:
ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী রাহু ও কেতু নামে দুটি ছায়া গ্রহ রয়েছে। পশ্চিমা জ্যোতিষশাস্ত্রে এদেরকে যথাক্রমে চাঁদের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বলা হতো। বিশ্বের অন্য কিছু অংশে এদেরকে যথাক্রমে ড্রাগনের মাথা এবং লেজ বলা হয়।
ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী মতে স্বরভানু নামে একটি অসুর সমুদ্র মন্থনে অংশ নিয়েছিল। মন্থনের ফলে একের পর এক রত্ন ও সম্পদ সাগর থেকে বেরিয়ে এসে দেবতা ও অসুরদের সমৃদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এল 'অমৃত'। যা পান করলে মৃত্যু হবে না। পুরাণ অনুসারে, যে কেউ এই অমৃত পান করেন তিনি অমর হবেন। মহাসমুদ্র মন্থন দেবতা ও অসুর একসাথে করেছিলেন। দেবতারা চিন্তিত ছিলেন যে অসুররাও যদি অমৃত পান করে তবে তারা অজেয় হয়ে উঠবে এবং এটি মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণের জন্য খুব খারাপ হবে। তাই, তারা ভগবান বিষ্ণুকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করলেন।
বিষ্ণু ছলনা করে অসুরদের মদ পান করিয়ে দেবতাদের অমৃত দিতে শুরু করে। স্বরভানু দেবতাদের সেই চালাকি বুঝতে পারে এবং দেবতার বেশ ধারণ করে অমৃত পান করে নেয়। চন্দ্রদেব ও সূর্যদেব স্বরভানুকে ধরিয়ে দেয় এবং বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে তার মুন্ড ছেদন করে। মুন্ডটা রাহু এবং ধরটি কেতু নামে দুটি আলাদা সত্ত্বা ধারন করে।
সমুদ্র মন্থনের তত্ত্ব জ্ঞান:
সমুদ্র মন্থন হলো মানুষের মগজে নেতিবাচক ও ইতিবাচক সিদ্ধান্তের সংঘর্ষ, যাহা দ্বারা জ্ঞানের মন্থন হয়। এই মন্থনের দ্বারা বিভিন্ন ঐশ্বর্য্য ও ধন সম্পদ প্রাপ্ত হয়। পালন কর্তা ভগবান নেতিবাচক শক্তিদের মদিরা পান করিয়ে অচৈতন্য করে রাখেন এবং ইতিবাচক শক্তিকে অমৃত সুধা পান করিয়ে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করেন।
জ্যোতিষ ও বেদ মতে সূর্য হল আত্মার প্রতীক ও দেবতা, চাঁদ হলো মনের প্রতীক ও দেবতা এবং রাহু দ্বারা এদের গ্রহন লাগানোর অর্থ হলো জাতকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব। কোনো জাতকের একই রাশিতে সূর্য ও কেতু এক সঙ্গে অবস্থান করলে জাতকের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে মনে করা হয়।
একই রাশিতে চন্দ্র ও কেতু এক সঙ্গে অবস্থান করলে জাতকের মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে মনে করা হয়। এরকম বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানের Combination দ্বারা শুভাশুভ ফল নির্নয় করা হয়।
যদিও এই সকল বিশ্লেষণের কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি আমার জানা নেই তবুও এসকল আমাদের সংস্কৃতিক পরিচয়। এগুলোকে কুসংস্কার বলা যুক্তি সঙ্গত নয়। কারণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে গেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রয়োজন নেই। ব্যাবহার করা জানলেই হবে। সেভাবে, ধর্ম পালন করা জানলেই হবে।
0 Comments: