হিন্দু সমাজে জাত ও বর্ণ প্রথার বহু প্রাচীণ ইতিহাস আছে। এই জাত ও বর্ণ কি বস্তু সেটি না জেনেই অনেকে এ বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষন করে থাকে।
“বর্ণপ্রথা” শব্দটি ভুল। সঠিক শব্দটি হোলো — বর্ণ ও আশ্রম ধর্ম। চারটি বর্ণ এবং চারটি আশ্রম মিলে বর্ণাশ্রম ধর্ম হয়। এটি কোনো প্রথা নয়। এটিই আসল সনাতন ধর্মের পালনীয় ধর্ম।
এই বর্ণ ও আশ্রম ধর্মই প্রাচীন কাল থেকে ভারতের হিন্দু সমাজ মেনে আসছে। আজ ধর্মের মূল ধারণা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ আমরাই এর গুরুত্বকে ছোটো করেছি। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমারা পাশ্চাত্য ভাবধারায় আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে তুলনা করছি। তাই, বার বার আমরা নিকৃষ্ট বর্বর প্রমাণিত হচ্ছি। তাঁদের বর্বরতা গুলোই সভ্যতা মনে হচ্ছে। ঈশ্বর আরাধান পদ্ধতিকে ধর্ম হিসেবে মেনে নিচ্ছি।
হিন্দু, খ্রিস্টান, ইসলাম, ইহুদী —এগুলো ধর্ম নয়। এগুলো ধর্ম সাংস্কৃতি। প্রতিটি ধর্মের সঙ্গে জড়িত থাকে সাংস্কৃতি। সংষ্কৃতি তৈরী হয় সংস্কার দিয়ে।সেই সংস্কার দ্বারাই ধর্মের পরিচয় হয়। ঈশ্বর আরাধান পদ্ধতিকে ধর্ম বলে না। আরাধান পদ্ধতিকে বলা হয় উপাসনা।
হিন্দুদের উপাসনা পদ্ধতিতে পূজা, পাঠ, ন্যাস, জপ, হোম, দান, ও দক্ষিণা আছে। খ্রিস্টানদের আছে প্রার্থনা, বচন এবং হলি কমিনিউওন গ্রহণ করা। মুসলিমদের মধ্যে আযান, ওযূ ও সালাত (বা নামাজ) আদায় করার রীতি আছে। এগুলো এক জিনিস নয়।
ধর্মের মূলে রয়েছে বেদ। বেদে আছে সনাতন ধর্ম, বেদ ব্যতীত বাকি যা কিছু আছে, তাদের বলা হয় আচার ধর্ম। জাত এবং বর্ণ ব্যবস্থা বেদের ধর্ম। এই সামাজিক বিষয় গুলো আজ আমরা আলোচনা করবো।
যারা প্রচার করছে জাতি ও বর্ণের ভেদাভেদ তুলে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করার। তারা তো জানেই না জাত ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। এই ভেদাভেদ দূর করতে তারা সেই কাজটাই করে, যার বিরুদ্ধে তারা বিরোধ করতে নেমেছে।
উপমা দিয়ে বলতে গেলে, "লোহার শিকল খুলে তারা লোহার শিকল পরিয়ে দিচ্ছে"। এক জাতের বিরূদ্ধে আরেক জাতকে উস্কে দেওয়ার অর্থই হলো সমাজে ভেদাভেদ তৈরি করা। এক বর্ণের বিরুদ্ধে আরেক বর্ণকে লেলিয়ে দিয়ে। উচু জাত গুলোকে জব্দ করা হচ্ছে। এই বুদ্ধি দিয়ে কাজ করছে। এভাবে কখনো কি ভেদাভেদ নষ্ট করা সম্ভব? এরা বুদ্ধিজীবী।
জাত চেনা যায় যে ভাবে
জাত শব্দটি এসেছে জ্ঞাত শব্দ থেকে। অর্থাৎ কোনো কিছুকে জানার জন্য যে বিন্যাস, সেটাই জাত। বর্ণ শব্দটি শাস্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে গুণ ও কর্মের দ্বারা গঠিত সমাজের বিভিন্ন স্তরকে বোঝাতে। অর্থাৎ বর্ণ গুলোও এক একটি জাত।
এভাবেই আর্য(শ্রেষ্ঠ) এবং অনার্য(পতিত), সভ্য এবং অসভ্য, পশু এবং মানুব, দানব এবং দেবতা, এই গুলো জাত।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এই হলো চাতু:বর্ণ। ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্ত ও সন্ন্যাস এই চারটি হলো আশ্রম। এবার একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আর্য ও অনার্য
সদাচার, শিষ্ঠাচার, জ্ঞান, বিনয়, বীরত্ব এসকল আর্য জাতির লক্ষণ ও পরিচয়। কদাচার, অসভ্যতা, অজ্ঞান, উগ্রতা, ভীরুতা বা কর্ম বিমুখতা এবং অধর্ম এসকল অনার্য জাতির লক্ষণ।
মহাভারতে বিভিন্ন স্থানে আর্য কথার উল্লেখ করা হয়েছে। স্ত্রী তাঁর স্বামীকে, মন্ত্রী তাঁর রাজাকে আর্য বলে সম্বোধন করছে। সেই সেই রাজাও আবার কোনো ঋষি বা মহাপুরুষদের "হে আর্য" বলে সম্বোধন করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ আর্য কোনো জাতি সূচক বিভেদ নয়, আর্য একটি সম্মান সূচক সম্বোধন।
এই আর্য অনার্য নিয়ে ব্রাহ্মণ ও চন্ডাল, চামারদের প্রতি বিভেদ মূলক ঘৃন্য মতবাদ প্রচার করা হয়েছে, সেটি নিন্দনীয়।
চার বর্ণ ও ম্লেচ্ছ
হিন্দু ধর্মে চার বর্ণের কথা বলা হয়েছে, যথা: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। এই চার বর্ণের বাইরে যারা আছে, তাঁদের ম্লেচ্ছ বলা হয়।
বেদের বর্ণ ব্যবস্থা বিহীন, বর্বর, স্বেচ্ছাচারীদের মলেচ্ছ বলা হতো। শক, হুন, যবন, এরা ম্লেচ্ছ জাতি বলে পরিচিত।
পাশ্চাত্য দেশেও যে কেউ ধার্মিক গুরু বা রাজা হয়ে যায়না। সেখানেও বংশ পরিচয় একটি বিশাল বড় ফ্যাক্টর। যীশু খ্রীষ্টের পিতা কাঠের কাজ করতেন। কিন্তু তিনিও ছিলেন দাউদের বংশের উত্তরসুরী। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) খুরাইস বংশের উত্তরসুরী ছিলেন।
কিন্তু "ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় উচু জাত, বৈশ্য এবং শূদ্র ছোটো জাত” —এভাবে শাস্ত্র কখনো বলেনি। কেউ বড় বা ছোটো নয়। সকলেই এক ব্রহ্মের শরীর। শাস্ত্র সবাইকে ওই বিরাট পুরুষের দেহের অঙ্গ রূপে জহির করেছে। ব্রাহ্মন মুখ, ক্ষত্রিয় হাত, বৈশ্য পেট এবং শূদ্র চরণ।
ব্রাহ্মণ
ব্রাহ্মণ দান, ভিক্ষা, শিক্ষা ও সেবার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই, সে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে না, রাজত্ব করতে পারবে না। করলে তাকে পতিত ব্রাহ্মণ বলা হবে।
যদিও ব্রাহ্মণকে সকল বিশ্বের স্বামী বলা হয়েছে, তবুও স্বেচ্ছায় যথেচ্ছ কাজ করতে পারবে না। অন্য কোনো উপায়ে ব্রাহ্মণদের আয় করা বা সম্পত্তি বর্ধন করার পথ নেই। সে যদি দ্বিজ 'বেদ ত্যাগ করে' অন্য বিষয়ে শ্রম করে, অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের জন্য চেষ্টা করে। সে নিজের পরিবার সহিত শূদ্র বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ, শূদ্র একটি পরিচয় মাত্র।
ক্ষত্রিয়
সৈনিক, সামরিক ও রাজা এরা, যারা সমাজকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে, এরা হোলো ক্ষত্রিয়। রাজাকে তাঁর জনগণের পিতার মতো প্রজাদের পালন ও শাসন করে। সে তাঁর রাজকোষ এবং অর্থ দ্বারা প্রজাদের সেবার জন্য পথ, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় ও সামরিক শাসন দ্বারা শান্তি বজায় রাখার কাজ করেন। তিনি যদি রাজ কাজ ছেড়ে ধর্মের জ্ঞান দিয়ে বেড়ান, তবে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে।
তাই, রাজার রাজদণ্ড তাঁর ব্যক্তিগত সুখের চেয়েও বড়। একজন প্রকৃত রাজা কখনোই নিজের প্রজাকে কষ্ট বা শোষন করবে না।
রাজার রাজদণ্ড যেভাবে প্রজাদের শাসন করে, সেভাবে সেটি তাঁর ওপরেও শাসন করে। তাই, সীতা, লক্ষ্মণ রানী হয়েও রাজদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিলো।
বৈশ্য
পেট যেমন সমগ্র দেহে পুষ্টি বর্ধন করে, পেটে যেমন খাদ্য সঞ্চয় হয়, বৈশ্য সেরকমই রাজ্য বা দেশের জন্য ধন সঞ্চয় ও বৃদ্ধি করে। বৈশ্য কর্মসংস্থান তৈরি করে। কৃষক, পশু পালক, ব্যাবসায়ী, বিনিয়োগ পতি, স্বর্নকার, কামার, ছুতোর এরা বৈশ্য।
এঁদের দ্বারাই দেশের জনে জনে অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান সম্ভব হয়। বিশে বিশে সেবা করার জন্য সে বৈশ্য বা বিশপতি। বিশপতির ক্ষমতা বাড়তে থাকলে সে রাজা হয়ে যায়।
শূদ্র
মনুস্মৃতি বলছে— “দ্বিজ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র) বেদঅন্যত্র কুরুতে শ্রমম” অর্থাৎ যে দ্বিজ বেদকর্মত্যাগ করে' অন্য বিষয়ে শ্রম করে, তবে সে “শূদ্রত্মগাচ্ছাতি সন্যায়ঃ।” অর্থাৎ সে পরিবার সহিত শূদ্র বলে গণ্য হবে।
শূদ্র হলো বেতন বা ভাতা ধারী কর্মী। নাপিত, বা যে কোনো বেতন ভোগী কর্মচারী বা সেবক শূদ্র। এই শূদ্রকে† ঈশ্বরের চরণ বলা হয়েছে। কেন?
কারণ, শূদ্র বৈশ্য, ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণের সহকারী কর্মী। শূদ্র ব্রাহ্মণের বেদী তৈরী করে। খৌর কর্মে শূদ্র অশৌচ ব্যক্তিকে শৌচতা প্রদান করে। শূদ্র রাজ কর্মচারী হিসেবে রাজা ও রাজ্জানুবর্গের বিভিন্ন সেবা করে। অর্থাৎ, সমজের গতির জন্য শূদ্র দায় প্রাপ্ত।
† চন্ডাল: যে ব্যক্তি নীচ এবং উগ্র স্বভাবের হয়, সে ব্রাহ্মণ হলেও চন্ডাল বলে কথিত। আবার, জাতিগত ভাবেও চন্ডাল জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। alert-info
মিশ্র বর্ণ বা বর্ণ সংকর:
বর্ণ সংকর কথার শাব্দিক অর্থ দুই বা ভিন্ন বর্ণের মিশ্রণ। কিন্তু, তাৎপর্য অর্থে এটি ব্যভিচার বা দুর্নীতি বোঝায়। কোনো কারণে দুই ভিন্ন বর্ণের নারী ও পুরুষের মিলনে যে সন্তান জন্ম হয়। সেই সন্তানকে মিশ্র বর্ণ বা বর্ণ সংকর বলা হয়।
যেভাবে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণ নির্দিষ্ট কর্মে নিয়োজিত ছিল। উৎপন্ন সংকর জাতের জন্য ওই কর্মের আরো অধিকার ভেদ তৈরী হলো। উদাহরণ স্বরূপ মল্য, তেলী, গোপ, ইত্যাদি নতুন জাত উৎপন্ন হলো। মল্য অর্থাৎ যারা আজকে ফুলের কাজ করে বা মালি, তেলী তিল পেশন করে তেল বানায়, গোপ গো পালন করে।
এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এখানে ব্যভিচার বা দুর্নীতি কোথায় প্রমাণিত হলো? তাঁর জন্য আমদের আশ্রম ব্যবস্থা বুঝতে হবে।
আশ্রম ধর্মের বিভিন্ন বিভাগ।
শ্রম কথার অর্থ হলো 'কর্ম করা'। আশ্রম কথার অর্থ হলো “শ্রমের সঙ্গে”। শৈশবকাল, বাল্যকাল, যৌবনকাল, ও বার্ধক্য এই চার পর্যায়ে কখন কেমন শ্রম বা কর্ম করতে হবে তাহা শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এর চারটি স্তর: ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস।
ব্রহ্মচর্য আশ্রম
শৈশবকাল থেকে বাল্য কাল পিতা মাতার সঙ্গে কেটে যায়। তখন নিজের ধর্ম বা কর্তব্য সম্পর্কে কারো কোনো জ্ঞান থাকে না।
তারপর উপনয়ন সংস্কার হলে বাবা মায়ের ঘর ছেড়ে গুরু গৃহ বা আশ্রমে গিয়ে ব্রহ্মচর্য অবলম্বনপূর্বক শিক্ষা অর্জন করতে হয়। এই সময়ে ব্রহ্মচর্য আশ্রম বলা হয়।
ব্রহ্মচর্য আশ্রমে শিষ্য গুরুর আচরণ শেখে। গুরুর শেখানো পথ অনুসরণ করে। এরপর বারো বা অধিক বছর ব্রহ্মচর্য পুষ্ট হলে। শিখা ছেদন করে গৃহস্থ আশ্রমে প্রবেশ করতে হতো। অর্থাৎ স্ত্রী, পুত্র, পিতা-মাতার সঙ্গে পরিবার নিয়ে বাস করতে নিজের গৃহে ফেরত আসতে হয়।
গৃহস্থ আশ্রম:
গৃহস্থ আশ্রমকে সকল আশ্রমের আশ্রয় বলা হয়েছে। কারণ, ব্রহ্মচারীর জন্ম গৃহস্থে হয়, ব্রহ্মচারীকে গৃহস্থের কুটিরেই ভিক্ষা করতে আসতে হয়। আবার গুরকুল নিজেই একটি গৃহস্থ বাড়ী।
বানপ্রস্ত আশ্রম:
দাম্পত্য জীবনের শেষে, বা পুনরায় গুরু গৃহে অথবা তপবনে তপস্যার মাধ্যমে জীবনের অন্তিম সময় গুলো ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করা কে বনপ্রস্থ বলা হয়।
সন্ন্যাস আশ্রম:
সাংসারিক জীবনে মানুষের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আসে। একটা সময় নিজেকে অসহায় মনে হয়। ওই সময় মন দেহ ত্যাগের কথা ভাবে। বিবেকবান ব্যক্তি সংসারের মোহ ত্যাগ করে ঈশ্বরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এক সন্ন্যাস বলা হয়।
$ads={1}
বেদ শিক্ষা শূদ্রের অধিকার কেন নেই
শিক্ষা বা বিদ্যা অর্জন করা সকলের অধিকার। কিন্তু জ্ঞান কখনই অধিকারের পর্যায়ে আসে না। কারণ একই শিক্ষা পেয়ে সবার একই জ্ঞান হয় না। জ্ঞান সম্পূর্ণ একান্ত বিষয়। এটা মানুষের অন্তরে প্রকাশ পায়। বেদ শিক্ষা শূদ্রের অধিকারে নেই এমনটি মোটেও সত্য নয়। শূদ্রের বেদ অনুসারে পূজার প্রয়োজন নেই।
শূদ্র বেদের অন্তর্গত একটি ব্যবস্থা। বেদ সকলের জন্য। কিন্তু শূদ্র বেদের উপভাগ (যেমন: উপনিষদ, পুরাণ, তন্ত্র ইত্যাদি করতে পারে । শূদ্রের জন্য পাকযজ্ঞ আছে। পাকযজ্ঞ করতে ব্রাহ্মণ পুরোহিত দরকার হয় না বরং শূদ্রই পৌরহিত্য করে।
পকযজ্ঞ কি কি?
এই পকযজ্ঞ তিনটি ভাগে বিভক্ত: ১) হুত, ২) আহুত এবং ৪) প্রহুত। অন্নপ্রাসন, উপনয়ন, বিবাহ, অন্তেষ্ঠি, শ্রাদ্ধশান্তি সব কিছুতেই তো শূদ্রের প্রয়জন হয়।
এক কথায় শূদ্রের বৈদিক দায় নেই। কারণ শূদ্রের উপনয়ন সংস্কার নেই। শূদ্র শুদ্ধ মনে যেভাবে ঈশ্বরের সেবা করেন, সরল ভাবে ঈশ্বর তাই গ্রহণ করেন।
শূদ্র ব্রাহ্মণের আচরণ করতে পারবে না।
আচরণ উপলদ্ধির জন্য। হ্যা, শাস্ত্র বলছে, "শূদ্র ব্রাহ্মণের আচরণ করতে পারবে না"। এটাই সত্য। শূদ্রকে ব্রাহ্মণের আচার যেমন: পৌরোহিত্য, বেদ শিক্ষা, গুরু গিরি ইত্যাদি থেকে বিরত রাখা হয়েছে। কারণ, ব্রাহ্মণকে রাখা হয়েছে নিয়ম ও নিষ্ঠার গন্ডিতে। একজন শূদ্রর সেই বলাই নেই। এটি কোনো বৈষম্য নয়, এটি বিধান।
ভেবে বলুন, শূদ্র নিজের সহজ আচরণ বাদ দিয়ে অন্যের কঠিন আচরণ কেন করবে?
যে ভাবে বিদ্যালয়ের ক্ষুদে বালককে যদি উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন পড়ানোর চেষ্টা করা হয় তবে সে কিছুই বুঝতে পারবে না। সেভাবেই শূদ্রের জন্য ব্রাহ্মণের সুক্ষ্ম আচরণ বিহিত নয়, শূদ্রের জন্য স্থুল আচরণ।
ব্রাহ্মণের সুক্ষ্ম আচরণ গ্রহন করলেও অনুকরণ করতে পারবে ঠিকই কিন্তু তাহা যথাযথ পালন করতে পারবে না। সেটা ভন্ডামি ছাড়া আর কিছু হবে না। ভন্ডামি হলে দূর্ণাম হবে ব্রাহ্মণের, আজ সেটাই হচ্ছে। রামরোহিম, আশারাম জেল খাটা আধ্যাত্মিক গুরুরা, এরা কেউই ব্রাহ্মণ নয়।
যোগ্যতা ছাড়া যে কেউ, তোতা পাখির মতোই আচরণ করবে, কিন্তু কোনো ফল হবে না, কোনো উপলদ্ধি হবে না।
$ads={2}
ব্রাহ্মণ যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, সে যে সকল নিষ্ঠা, শিক্ষা, আচার অনুষ্ঠান করে অভ্যস্থ। একজন শূদ্রের ক্ষেত্রে সেটা সহজ হবে না। তাই, খুব বেশী সম্ভাবনা থাকবে সে নিজের সুবিধা অনুযায়ী বিধান দেবে।
উল্টো দিকে ব্রাহ্মণের পক্ষেও শূদ্রের মতো জীবন নির্বাহ করাও কষ্টকর।
ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহন করলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায়
শাস্ত্র তো এটাই বলেছে যে জন্মগত ভাবে সবাই শূদ্র হয়ে জন্মায়। সংস্কার দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণে উপনয়ন সংস্কার করা হয়। শূদ্রের উপনয়ন সংস্কার নেই। তাই, তাদের বেদ অধ্যয়ন বা অধ্যাপনা থেকে বিরত করা হয়েছে। তাই যে যেই বর্ণের সে সেই বর্ণের অন্তর্গত। বর্ণ জন্মগত। কর্মের দ্বারাও বর্ণ পরিবর্তন হয়। নীচ কর্ম করে পতন হয়।
মূর্খ মনে করে ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহন করলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। কিন্তু তারা এটা ভূলে যায়। জন্মই যথেষ্ট নয়। নিজের ব্রাহ্মণত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে কিছু কিছু Terms and conditions মেনে চলতে হবে। যোগ্য সূত্র অর্থাৎ পৈতে ধারণ করে যদি কোনো বিপ্র বেদ অধ্যায়ন না করে অন্য বিষয়ে পরিশ্রম করে তবে ওই বিপ্র ব্রাহ্মণত্ব চ্যুত হয়ে পরিবার সহিত শূদ্র বলে গন্য হয়। অভিবাদনের প্রত্যাঅভিবাদন না করলেও ব্রাহ্মণত্ব চ্যুত হয়ে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। আবার শূদ্র কন্যা যদি ব্রাহ্মণ পূরুষের সঙ্গে বিবাহ করে কণ্য সন্তান জন্ম দেয়। এভাবে সপ্তম প্রজন্মের পর ওই শূদ্র কন্যার কন্যার সপ্তম প্রজন্মের সন্তান বা সন্ততি শূদ্রত্ব মুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ হয়ে যায়। এভাবেই ব্রাহ্মণ শূদ্র হয় এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়।
তাহলে আমরা দেখলাম, বর্ণ জন্মগত। আবার দেখালাম এটি পরিবর্তন করাও সম্ভব। তাই, বর্ণ নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী একে ব্যবহার করে এসেছে। বর্ণ ভেদ নিয়ে আজকে আমাদের মধ্যে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, সেটা বেশির ভাগই অপপ্রচারের কারণে। রামায়নের জাবাল ঋষি থেকে শুরু করে মহাভারতের মৎস্যগন্ধা সবেতেই বর্ণ পরিবর্তন দেখা গেছে। ঋষি জাবাল বেশ্যা পুত্র হাওয়া সত্বেও বেদ জ্ঞান অর্জন করেছেন। মৎস্যগন্ধা মেছনী হাওয়া সত্বেও রাজ পরিবরের গৃহবধূ রাজমাতার আসন পেয়েছে। আবার কেউ যদি বলে এদের পূর্ব পুরুষ ব্রাহ্মন বা ক্ষত্রিয় ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে। তবে মনুস্মৃতি বলেছে যে — শূদ্রদের জন্ম বশিষ্ঠ ঋষির গোত্র থেকে। যাহাই হোক, আমরা সবাই ইশ্বরের অংশ। এটাই যথেষ্ট জ্ঞান। যে যে কর্মেই নিযুক্ত থাকি না কেন, আমরা সমজরূপি ইশ্বরের সেবাই করেছি। তাই, "স্বধর্ম নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ।"
স্বধর্ম পালন করা উচিত:
শূদ্র ব্রাহ্মণের আচরণ করতে পারবেনা, অনুরূপভাবে ব্রাহ্মণও শূদ্রের আচরণ করতে পারবেন না। তাই বর্ণ অনুযায়ীই স্বধর্ম পালন করা উচিত। উত্তম রূপে অনুষ্ঠিত অন্যের ধর্ম আচরন করার চেয়ে নিজ ধর্ম আচরন উত্তম। কারণ বিধর্ম পালনের ফল ভয়াবহ।
একজন ব্যবসায়ী যদি ধর্মগুরু হয় তবে সে ধর্মকে ব্যাবসার মতো প্রচার করবে। একজন রাজ্নেতা যদি ধর্মগুরু হয় তবে সে ধর্মকে রাজনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করবে। তাহলে ধর্ম কি নিজের আসল স্বরুপ বজায় রাখতে পারবে? অধর্ম আর ধর্ম নিয়ে মানুষ অবশ্যই বিভ্রান্ত হবেন। ধর্ম ছেড়ে দিন যে কোনো ক্ষেত্রেই এটিই সত্য। আজকাল ডাক্তার রোগীর সেবা করে না। তারা রোগের ব্যাবসা করে। হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসার আগে টাকা জমা করতে হয়। এগুলো কি ধর্মের গ্লানি নয়?
শূদ্র পৌরহিত্য করে
বেদ মতে শূদ্র পৌরহিত্য করে না। কিন্তু তন্ত্র শাস্ত্র মতে শূদ্র তান্ত্রিক মার্গে পৌরহিত্য করার উপযোগী। যেহেতু শূদ্রকে পৌরহিত্য করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেই জন্যে তন্ত্রকে অনেক ভাবে ভুল ব্যাখ্যা করে কুলষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তন্ত্র মার্গে বেদ থেকেই তন্ত্রের আগমণ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন