ভূমিকা:
আমি কে? — এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমরা পৌঁছে যাই চিরন্তন সত্যের সন্ধানে। যেখানে আমি ও এই জগত,— এই বোধই শেষ কথা। লব্দ জ্ঞানের উপলদ্ধি, আমার আপনার সকলের জন্য এক।
কখনো কি মনে হয়েছে, “আমি কি শুধুই হাড় মাংসের কাঠামো? নাকি আমি এই শরীর ছাড়াও কোনো এক চেতন সত্তা।”
যদি আমি কেবলই কেমিক্যালের একটি জটিল তন্ত্র হই, তাহলে আমার এই জীবনের উদ্দেশ্য কি?
প্রকৃতিই যদি আমায় সৃষ্টি করে তাহলে এই প্রকৃতি কিভাবে এসেছে? কি ভাবে কাজ করছে? কেউকি প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে নাকি সে নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে?
এই সকল প্রশ্নই মানুষকে ভৌত বিজ্ঞান ও আধ্যাত্ম জ্ঞানের পথে চালিত করেছে । একদল পদার্থ, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আরেকদল মন, বুদ্ধি, চেতনা এই দিকে অগ্রসর হয়েছে।
বিজ্ঞানের সব অনুসন্ধান গুলো জড় পদার্থ নিয়ে। কিন্তু আধাত্মের অনুসন্ধান চেতনা নিয়ে।
জড় (Matter) কী?
জড় হল পরিবর্তনশীল, অনুভূতিশূন্য বস্তু। এই পৃথিবীর প্রতিটি উপাদান, দেহ, বস্তু, শক্তি—সবই জড়ের অন্তর্ভুক্ত। এটি নিজে কিছু করতে পারে না, কিন্তু চেতনার সংস্পর্শে এলে প্রাণ পায়।
চেতনা (Consciousness) কী?
চেতনা হল সেই অভ্যন্তরীণ শক্তি যা দিয়ে আমরা অনুভব করি, বিচার করি, সিদ্ধান্ত নিই। এটি কোনো জড় পদার্থ নয়, বরং আত্মিক অস্তিত্ব। উপনিষদে বলা হয়েছে: “চৈতন্যং হি আত্মা” — চেতনা-ই আত্মা।
চেতনার স্তর তিনটি:
- জাগ্রত চেতনা
- স্বপ্ন চেতনা
- সুসুপ্ত চেতনা
এই তিন স্তর মিলে গড়ে ওঠে আমাদের অন্তর্জগৎ, যা সময় ও স্থানের বাইরে নিজস্ব অস্তিত্ব বহন করে।
অধ্যাত্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো লড়াই নেই বা থাকতে পারে না। কারণ দুইজনই একই সত্যের সন্ধানে। উভয়ের শত্রু হলো অজ্ঞানতা।
কেউ বিজ্ঞান বিশ্বাস করে বলে আধ্যাত্মকে কাল্পনিক গল্প কথা মনে করে। আবার যারা আধ্যাত্মকে বিশ্বাস করে তারা বিজ্ঞানকে সীমিত জ্ঞান মনে করে। অথচ, বিজ্ঞানের জটিল সমস্যার সমাধানে মনন, চিন্তন, বিশ্লেষণের প্রয়োজন। এই বিষয় গুলো আধ্যাত্মিক বিষয়। আবার এমন কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিও নেই যারা জড় জগতের সুবিধা ভোগ করে না। ঘড়ি, ছড়ি, ঘটি বাটি থেকে শুরু করে খড়ম, চামর, টাকা-কড়ি। সবই ভৌত পদার্থ।
তাই, হিন্দু ধর্মে দর্শন শাস্ত্রের ছড়াছড়ি।
দর্শনের ব্যাখ্যা: চেতন বনাম জড়
সংখ্য দর্শন:
চেতন ও জড় দুইটি আলাদা তত্ত্ব। পুরুষ (চেতনা) দর্শক, প্রকৃতি (জড়) কর্মী। সংখ্য মতে, পুরুষ (ব্রহ্ম) নিজে কিছু করে না—সে নির্বিকার দর্শক (দ্রষ্টা)। প্রকৃতি, পুরুষের চেতনার প্রতিবিম্ব পেয়ে সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করে।
অদ্বৈত দর্শন:
চেতন ও জড় আলাদা কিছু নয়; ব্রহ্মের দুইটি প্রকাশ মাত্র। বিভেদ কেবল মায়ার সৃষ্টি।
বৈশেষিক দর্শন:
চেতন (আত্মা) ও জড় (পঞ্চভূত ও অন্যান্য দ্রব্য) — উভয়ই স্বতন্ত্র, চিরন্তন ও বাস্তব। আত্মা চেতনার আধার হলেও তা নিজের থেকে কার্যক্ষম নয়, ইন্দ্রিয় ও শরীরের সংযোগ ছাড়া। জড় পদার্থ গঠিত পারমাণবিক কণিকা ও গুণ থেকে। এই দর্শন জড় ও চেতনার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্টিজগত ব্যাখ্যা করে।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে চেতন ও জড়
জড়:
বিজ্ঞান বলে, জড় হল পার্টিকল ও শক্তির সংমিশ্রণ। পদার্থবিজ্ঞানের E=mc² সূত্রে প্রমাণ—জড় পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরযোগ্য।
চেতনা:
বিজ্ঞান এখনও নিশ্চিত নয় চেতনা কেবল নিউরনের ক্রিয়া, না কি এটি মহাজাগতিক শক্তি। কিছু মতবাদ:
- Neuroscience View: চেতনা = নিউরনের সক্রিয়তা,
- Quantum Consciousness: চেতনা কোয়ান্টাম স্তরে উদ্ভূত,
- Panpsychism: জগতের প্রতিটি কণার মধ্যেই চেতনা বিদ্যমান।
কালী-শিব প্রতীক: এক অলৌকিক দর্শন
কালী এখানে প্রকৃতি বা জড়ের প্রতীক। তিনি সময়ের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় ঘটান। শিব (চেতন) নিচে শুয়ে আছেন — কর্মক্ষম নন, কিন্তু উপস্থিত। কালী চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে জগতকে চালিত করেন।
এই চিত্র আমাদের বলে — চেতনা ছাড়া জড় মৃত, আর জড় ছাড়া চেতনা প্রকাশহীন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন