হিন্দুধর্মে মূর্তি পূজার ধারণাটি প্রচলিত মূর্তি পূজা থেকে একেবারে ভিন্ন। তাছাড়া মূর্তি পূজাকে পাপ মনে করা হয়েছে আব্রাহামিক ধর্ম গুলোতে, হিন্দু ধর্মে নয়।
পূজনীয় ব্যক্তিদেরই পূজা করা হয়। অর্থাৎ যথা সম্ভব সম্মান করা হয়। পূজা শব্দের অর্থ ইবাদত বা ঈশ্বরের কাছে নত হওয়া নয়।
ভূমিকাঃ
হিন্দুদের মূর্তির পূজায় ভুল কোথায়? ঈশ্বর কি শুধু নিরাকারেই সীমিত? ইশ্বরের কি ক্ষমতা নেই সাকারে প্রকট হওয়ার? হিন্দুদের উপনিষদ ঈশ্বরকে সাকার এবং নিরাকার উভয়ই রূপেই স্বীকার করেছে। যদি মুসলমানরা বাজার থেকে কিনে আনা কোরআন পড়ে, আল্লাহর বানীর অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে পারেন। সেই বইকে সম্মানের সঙ্গে মাথায় তুলে রাখতে পারে। হিন্দু মূর্তি পূজা করলে দোষ কীভাবে হবে?
কাগজের বই কোরান!
ইসলাম ধর্ম যদি সত্যিই মূর্তি পূজার বিরোধী হয় তবে কোরআন শরীফ জ্বালিয়ে দেওয়ায় কিভাবে আল্লাহর অপমান হয়? কোরআনকে কি তারা শুধুই কাগজের বই মনে করে? যদি কাগজের তৈরী কুরআনে আল্লার বাণী থাকতে পারে। মাটির মূর্তিতে দেবতা কেন থাকবে না ?
বিড়ম্বনা দেখুন, মূর্তি ভেঙে একজন মুসলমান উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ ফ্রান্সে প্রকাশ্যে কোরআন জ্বালিয়ে অনেক নাস্তিক বা এক্স-মুসলিম জীবন বাঁচাতে লুকিয়ে আছে। কেন? এই একটা কাগজের বইয়ের মূল্য মুসলমানের কাছে এক মানুষের জীবনের থেকেও বড়, নাকি কাফের বলে তার জীবনের মূল্য কম?
আল্লাহ তো নিজের বানীকে বাঁচাতে পারছে না। ধর্ম অবমাননা করে মানুষেরা জীবন খোয়াতে হচ্ছে । এটাই কি তাঁর আদেশ। তিনি তো সর্ব শক্তিমান, তিনিও তো ওই মাটি, পাথর, ধাতুর মুর্তি গুলোর মতোই কিছুই করতে পারছে না!
অস্তিত্বের সংগ্রাম
আসলে মূর্তিতে ইসলাম বা আব্রাহামিয় ধর্মের সরাসরি কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধা হল স্ব ধর্ম ত্যাগ করে যারা মজহ্বী ধর্ম অনুসরণ করছে। তারা নিজেদের সঠিক প্রমাণ করতে চায়। সেই জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে তাদের এতো ঘৃণা। আসলে এরা না পরছে গিলতে, আর না পরছে উগ্লোতে।
এক দিকে হিন্দুদের ঈশ্বরের ব্যাক্ত রূপের পূজা অন্য দিকে অনুমানের ভিত্তিতে আল্লাহর উপাসনা। প্রকট রূপের সামনে অনুমানের স্রষ্টার প্রতি এই তৌহিদী বিশ্বাসের ভিত্তি মাঝে মাঝেই দুর্বল হয়ে যায়। অবিশ্বাস, নাস্তিকতা এবং সন্দেহ খুব সহজেই তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই নিরাপত্তাহীনতায় তাঁরা মুর্তি ভাঙ্গে।
হিন্দুরাও নিরকারে বিশ্বাসী। পরমব্রহ্মের কোনো মূর্তি নেই। তাহলে এই মূর্তি গুলো কি?
এই মূর্তি গুলো দেবী ও দেবতার। তারাও আমার আপনার মতই সাকার। সেই সাকারের যেমন: গাছ নদী, সূর্য ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়। এটাই হিন্দুর পূজা। হিন্দু নিজের দেবতার মূর্তি বানায়। সেই মূর্তিতে ওই ব্রহ্ম স্বরূপ দেবতার আবাহন করে। পূজার শেষে, মূর্তি বিসর্জন দিয়ে, হিন্দু বার বার প্রমাণ করে— “হিন্দুরা মূর্তি পূজক নন”।
একজন মুর্তি ভঞ্জক বা মুসলমান নিজের ধর্মপুস্তক জ্বালিয়ে প্রমাণ করুণ, ওটা একটা কাগজের তৈরী বই মাত্র।
মূর্তি কি?
মূর্তি হলো একটা "প্রতীক" যার মাধ্যমে ভক্ত ঈশ্বরকে স্মরণ করেন। যেভাবে শব্দ বা অক্ষর A, B, C, D বা ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি আকারে লিখিত হয়। সেভাবেই ঈশ্বরের গুণ, লীলা ও ঐশ্বর্য্য শাস্ত্রে যে ভাবে বলা হয়েছে, তদনুরূপে দেবমূর্তি তৈরী করা হয়। এতে করে দেবতার গুণ, লীলা ও ঐশ্বর্য্য ভক্তের হৃদয়ে আজীবন জাগ্রত থাকে।
যে কোনো মূর্তি স্বয়ং ঈশ্বর নয়, যতক্ষন ভক্তের প্রেমভাব বা আবাহন ওই মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হয়, ততক্ষণ ওই মূর্তি পুতুলের মতোই। কারণ, হিন্দুধর্মে ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্টিকে অভেদ বলে মানে করা হয়। “একম এব অদ্বিতীয়ম” — এক এবং অদ্বিতীয়। এর অর্থ এই নয় যে তিনি একমাত্র উপাস্য। বরং, তিনিই জগতের সব রূপে, সর্ব ভূতে, এক।
মূর্তি পূজা বার বার করবো !
যখন হিন্দু প্রশ্ন করে কাবা ঘর তো মানুষ নিজের হাতে বানিয়েছে। তাহলে যে কোনো দিক চারা মানব সৃষ্ট ইমারতের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার কি কারণ? এর উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি কোরআনের সুরা আল-বাকারার (২:১৪৪):
"আমরা তোমার মুখ আকাশের দিকে ঘুরতে দেখছি। সুতরাং অবশ্যই আমরা তোমাকে এমন ক্বিবলার দিকে ফেরাবো, যা তুমি পছন্দ কর। এখন তুমি তোমার মুখ মসজিদুল হারামের দিকে ফিরিয়ে নাও। আর তোমরা যেখানে থাকো না কেন, তোমরা তোমাদের মুখ ওই দিকেই ফেরাও। নিশ্চয়ই যেসব লোককে কিতাব দেয়া হয়েছিল (বনি ইসরাইল), তারা জানে যে, এটি তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।"
অর্থাৎ কিবলা বা কাবা ঘর আল্লাহ কতৃর্ক তাঁদের নির্দেশিত দিক। এবার হিন্দু ধর্মের কি এমন কোনো ঈশ্বর নির্দেশিত মূর্তি পূজার বিধান রয়েছে?
উত্তর হলো হ্যা, সমগ্র বেড়েই অগ্নী, বরুণ, ইন্দ্র রুদ্র, অর্যমা প্রভৃতি দেবতার উপাসনা ও পুজার উল্লেখ আছে। উদাহরণ স্বরূপ ঋগ-বেদের প্রথম মন্ত্র অগ্নীর উপাসনার কথা বলছে।
মানুষ নির্মিত কাগজ কালির বই কোরআন কেবল কাগজ বা কালি নয়, বরং এতে আল্লাহর বাণী রয়েছে। সেই শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে তারা ওই পুস্তককে মাথার উপর রাখেন
সেই একই ভাবে হিন্দুরাও বিশ্বাস করেন, পূজিত মূর্তি কেবল মাটি বা পাথর নয়, বরং এতে ভক্তির মাধ্যমে চেতনাবান ঈশ্বরের প্রতিফলন।
মুসলিম ব্যক্তির যুক্তি
হিন্দুদের মূর্তির পূজায় ভুল কোথায়?
মুসলমান সব সময় কোরআন কিনে পড়েনা। কুরআনের বাণী যেই বয়ের ভেতর থাকে - সেটা কেনে। হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে।
আমার বক্তব্য হলো বই না থাকলে আল্লাহর বাণী যেভাবে মুসলমানদের কাছে পৌঁছত না। মূর্তি বা প্রতীক না থাকলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানুষ ভুলে যেতো। একজন মুসলিম যখন নামাজ পড়তে বসে, সে কি আল্লাহকে স্মরণ করে? নাকি, তার মন পড়ে থাকে নিজের দোকান, বাড়ি, বউ-বাচ্চা, ব্যবসার দিকে। নিশ্চই সে আল্লাহর কথা ভাবে না।
কারণ , আল্লাহর কোনো স্বরূপ নেই। আর মানুষের মন রূপের অনুরাগী। একজন মুসলিম নামাজের সময় শুধু কিছু ধর্মীয় পদ্ধতি , যা সে শিখেছে সেটাই পালন করে। কিন্তু হিন্দু তাঁর দেবতার অস্তিত্ব সম্মুখে দেখতে রেখে মনকে নিবদ্ধ করে।
ইশ্বরের কি ক্ষমতা নেই সাকারে প্রকট হওয়ার।
অবশ্যই আছে। কিন্তু বিষয়টি তাঁর ইচ্ছাধীন - আমাদের নয়। আল্লাহ নিজেকে প্রকট করে না।
—অর্থাৎ তিনি সাকার হতে পারেন। সেই সাকার স্বরুপকে আমরা অপরব্রহ্ম বলে জানি। আর নিরাকার কে হিন্দু পরব্রহ্ম বলে জানেন। এই জায়গায় মুসলিমদের জ্ঞান সীমিত।
আল্লাহ কিভাবে অপমানিত হয়?
আল্লাহ অপমানিত হননা। আল্লাহকে অপমান করার সাধ্য কারো নেই। অপমানিত হয় মুসলিম বান্দারা, তাদের ধর্মবিশ্বাস অপমানিত হয়।
—কিছুদিন আগে ফ্রান্সে এক ব্যক্তি কোরআন শরীফ জ্বালিয়েছে, হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নোংরা ভাষায় গালি দিয়েছে। ওই ব্যক্তিকে আইনি ভাবে আটক করা হলেও মুসলমানরা ওকে হত্যা করেছে। কোরআনের আয়াত উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে ওয়াজিবুল কতল। অর্থাৎ আল্লাহর বাণীতে স্পষ্ট হয় যে আল্লাহর অপমান বোধ আছে।
এই একটা কাগজের বইয়ের মূল্য।
কাগজের কোন মূল্য নেই, মূল্য আছে সম্মানের। আপনার ডায়েরি থেকে কেউ একটা পেইজ ছিড়লে আপনার গায়ে লাগবেনা, কিন্তু আপনার উচ্চশিক্ষার সনদ (সার্টিফিকেট)! সেটা ছিড়লে কেমন লাগবে?
— যার নিজের সম্মান বোধ আছে সে অপরকেও সম্মান দেয়। হিন্দুদের লিঙ্গপূজা, যোনীপূজা, গোমাংস দেখিয়ে ধর্মীয় ভাব আবেগে আঘাত করা বন্ধ করুন। হিন্দুদের লিঙ্গপূজা, যোনীপূজা, দেবতার মূর্তি হলো সেই উচ্চশিক্ষার সনদ।
যদি কাগজের তৈরী কুরআনে আল্লার বাণী থাকতে পারে। মাটির মূর্তিতে দেবতা কেন থাকবে না।
আল্লাহ্র বাণী আমরা পূজা করিনা। আল্লাহ্র বাণীতে যা লেখা আছে - সেইমত চলি, সেইমত কাজ করি। মূর্তির মধ্যে এমন কি দেখা যায়, বা মূর্তিতে এমন কি শক্তি আছে যে বড় বড় দেবতাদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে হবে?
— অর্থাৎ মূর্তিতে কোন অসুবিধা নেই। মূর্তির অস্তিত্বকেই আপনার পছন্দ করেন না। কুরআনের নিয়ম অনুসারে চলে আপনাদের কি উন্নতি হয়েছে? আর যারা ঈশ্বর মানে না, তাদেরই বা কি অবনতি হয়েছে? যদি, কোরআনের মত অনুসারে চলা আপনার অধিকার হতে পারে। তাহলে একজন হিন্দু কিভাবে তার ঈশ্বরকে ডাকবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কোরআন জ্বালিয়ে প্রমাণ
মূর্তি বিসর্জন দেয়া হয়, কারণ মূর্তি হল "কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালে পাজী"। আমাদের কাছে কোরআনের প্রয়োজন কখনো ফুরায় না যে ওটা আমরা জ্বালিয়ে আপনাদেরকে কিছু প্রমাণ করে দেখাবো।
—পূজার জন্য হিন্দুদেরও মূর্তির প্রয়োজন নেই। গ্রামাঞ্চলে অনেক দেবস্থান আছে, যেখানে কোন মূর্তি নেই। মূর্তি যে ঈশ্বর নয়। সেটা বোঝাতেই বিসর্জন দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কিছু মূর্তি যেগুলো প্রতিষ্ঠিত মঠ বা জ্যোতিরলিঙ্গ সেগুলো বিসর্জন দেওয়া হয় না। যেমন আপনাদের কাবার ওই কালো পাথর।
উপসংহার
হিন্দু ও মুসলিম—দুই সম্প্রদায়ই প্রতীক এবং ধর্মীয় গ্রন্থকে সম্মান দিয়ে থাকেন, তবে তার ব্যাখ্যা ভিন্ন। একে অপরের বিশ্বাসকে সম্মান করাই প্রকৃত ধর্মীয়তা।
এই ব্যাখ্যাগুলো দিয়ে আপনি যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন। তবে, বিতর্কের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পারস্পরিক বোঝাপড়া, বিরোধ সৃষ্টি নয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Welcome to our website!