এই আর্টিকেলে হিন্দু ধর্ম এবং এর প্রাচীন সংস্কৃতিকে ঘিরে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা এবং অপব্যাখ্যার প্রতিবাদ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মের পুরাণ ও শাস্ত্রকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার কারণে অনেক সময় ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা এবং তাৎপর্য হারিয়ে যায়।
সমগ্র বিশ্বে কেবল হিন্দু বৈদিক সনাতন ধর্ম প্রাচীণ ধর্ম গুলোর মধ্যে একটি, যা এখনও জীবিত আছে। রোম, গ্রীক, ইয়াজিদি ধর্ম গুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাঁদের পুরাণ ও ইতিহাসকে বিকৃত করে করে পেশ করা হয়। যেমন, ওডিন নিজের সন্তানকে হত্যা করে গিলে খেয়েছে, তারপর ইয়াজিদি দের দেবতা আর ইসলামের শয়তানের কাহিনী হবহু একই, কিন্তু একটু টুইস্ট করা।
সেই চেষ্টা হিন্দু পুরাণ ও ধর্মীয় রীতিনীতি গুলোর সাথেও হচ্ছে। তারা এমনটা জেনে করছে বা না জেনে করছে, সেটি আমার জানা নেই, তবে আমাদের সংস্কৃতির সত্যটা যদি আমরা না বলি, তবে কেউই আমাদের হয়ে বলতে আসবে না। আমরাও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবো।
📣 আরোপ ১: নরবলি
বলির নাম শুনলেই অনেকের নাক কুঁচকে যায়। তাঁর ওপর যদি বলা হয় নরবলি, তাহলে তো কথাই নেই। তন্ত্র শাস্ত্রে এমনকি রামায়ণের আদিকান্ডে নর বলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে এই প্রসঙ্গ টেনে বলে থাকেন, হিন্দু ধর্ম কুসংস্কারচ্ছন্ন, অন্ধভক্ত -দের ধর্ম।
আবার অনেক সময় অশ্বমেধ যজ্ঞকে অশ্ব বা ঘোড়ার বলি হিসেবে দেখানো হয়। এরকম গো-মেধ, পিতৃমেধ ইত্যাদি যজ্ঞের সঙ্গে কি অশ্ব, গো বা পিতার বলি দেওয়া হয়?
AI Generated নর বলির একটি কাল্পনিক চিত্র |
একদমই না, অশ্ব কথার সাংকেতিক অর্থ হলো দেশ। গো কথার সাংকেতিক অর্থ হলো পৃথিবী এবং পিতৃ কথার অর্থ হলো ঋষিদের পর প্রথম প্রজন্ম। এদের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞ করা হয় তাহাই অশ্ব-মেধ, গো-মেধ, পিতৃ-মেধ যজ্ঞ।
দেশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অশ্বমেধ, পূণ্য ও পৃথিবীর শান্তির উদ্দেশ্যে গোমেধ, পিতৃ পুরুষদের প্রীতির জন্য পিতৃ মেধ যজ্ঞ করা হয়। যজ্ঞের অগ্নীতে যে হবি নিবেদন করা হয় তাতে, চাল, কোলা, ঘী, যব, তিল, ইত্যাদি পবিত্র দ্রব্য থাকে।
মাংস, রক্ত, ইত্যাদি অপবিত্র দ্রব্য গুলো তন্ত্র শাস্ত্র আগম অনুযায়ী বর্জিত।
বর্ণ আশ্রমোচিতং ধর্মমবিচার্যার্পয়্ন্তি যে।
ভূত প্রেত পিশাচাস্তে অবন্তি ব্রহ্ম রাক্ষসাঃ।
— আগম সংহিতা
এর অর্থ এরকম — যারা বর্ণাশ্রমোচিত। ধর্ম বিচার না করে মহাশক্তি দেবীকে মাংস, রক্ত ও মদ অর্পন করে, তাহারা ভূত, পিশাচ স্বরূপর ব্রহ্ম রাক্ষস। এই জন্য তন্ত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভাগ আছে।
একবার এক আলোচনায় এক মুসলিম ভাই আমাদের কালিকা পুরাণ থেকে নিম্নোক্ত শ্লোক গুলো উদ্ধৃত করে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলো:
"যথাবিধি প্রদত্ত একটি নরবলিতে দেবী সহস্র বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন, আর তিনটি নরবলিতে লক্ষ বছর তৃপ্তি লাভ করেন।(কালিকাপুরাণ ৬৭/১৯)"নর মাংস দ্বারা কামাখ্যা দেবী এবং আমার রূপধারী ভৈরব তিন হাজার বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন।"(কালিকাপুরাণ ৬৭/২০)
আমি সেদিন কিছুই বলতে পারিনি। কারণ এই জ্ঞান আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিলো না। যেখানে দেবীকে মাংস রক্ত ও মদ বর্জনের কথা বলা হয়েছে সেখানে নর বলি কিভাবে সম্ভব? আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী ঠাকুর নিগমানন্দ পরমহংস দেবের তান্ত্রিক গুরু গ্রন্থ অধ্যয়ন করে জানতে পেরেছি— নর বলি অর্থে এখানে দেবীর নিমিত্তে "ময়দা ও গুর" নির্মিত মানব আকৃতির পিঠা বা মন্ড বলি দেওয়ার বিধান আছে। শব সাধনার পর দেবী সাধকের কাছে বলি চায়। যদি নর বলি চায়, তবে ময়দার পুতুল বানিয়ে বলি দিতে হয়। এখনো কামাখ্যায় দেবীর উদ্দেশ্যে পাঠা, পায়রা ও মোশ করে বলি হয়।
তন্ত্রে মানুষের বলি দেওয়ার কোনো বিধান নেই। পারম্পরিক জ্ঞান না থাকায় অজ্ঞানতা বশত কিছু কিছু অজ্ঞ এই বলিকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করে।
📣 আরোপ :২ সতীদাহ
এই গুলো উল্লেখ করে বলা হয়, এগুলো সতী দাহর প্রমাণ।
অগ্নি পুরাণ,গরুড় পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত সহ রামায়ণ মহাভারত মহাকাব্যে স্বেচ্ছায় প্রাণ ত্যাগ বা সহ মরণের কথা উল্লেখ আছে।
যেখানে বিধবা মহিলা বা পূরুষ স্বেচ্ছায় প্রাণ ত্যাগ করতেন। যোগ বলে প্রাণ রুদ্ধ করে, আত্মাকে ব্রহ্ম রন্ধ্র দ্বারা ঊর্ধ্বে তুলে প্রাণ ত্যাগ করতে পারতেন।এমন তেজস্বী নারীদের সতী নারী বলা হতো। আবার, যেহেতু অনেকেই এই পুরাণ মহাভারত অপ্রাসঙ্গিক বা কল্পনিক বলে উপহাস করে। তাই সেই অপ্রাসঙ্গিক বা কল্পনিক পুস্তক গুলোর থেকে সতী প্রথার মতো প্রথাকে সমর্থন করাও হাস্যকর।
সতীদাহ বলে কোনো প্রথা আদৌ ছিলো না। কোনো সধবা নারীর স্বামী থাকা অবস্থায় মৃত্যু হলে তাঁকে সতী নারী বলা হয়। মনে করা হয়, স্বামীর মৃত্যুকে তিনি নিজের ওপর ধারণ করেছে। এটা লোকের বিশ্বাস।
এছাড়া, যখন "বর্গী" এবং "ম্লেচ্ছরা" ভারতে আক্রমণ করতো, তখন তারা পুরুষদের হত্যা করে, ধণ সম্পদ লুঠ করে নারীদের তুলে নিয়ে যেত। সেই লুণ্ঠিত নারী কৃতদাসী বা যৌণ দাসী হয়ে থাকতো। এই দুর্দশায় জীবন কাটাতে হবে ভেবে বিধবা নারীরা নিজেকে জল সমাধি বা অগ্নী আহুতি দিতেন। রাণী পদ্মাবতীর জোহর একটা প্রমাণ।
ঋগ্বেদ- ১০/১৮/৭-৮ মন্ত্রে সতী দাহের কথা নেই।।বরং এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। বীরের বিধবা নারী যখন স্বামীকে চিতায় শেষ দেখা করতো। সেই সময় নারীকে উঠে আসতে বলা হয়েছে।
— "হে স্ত্রী ! আপনার পতি মৃত্যুকে গ্রহন করেছেন, অতএব তাঁকে ছেড়ে আপনি আপনার পুত্রাদি এবং ঘর-পরিবারের উপর চিন্তা করে উঠে আসুন। আপনি আপনার স্বামীর সাথে সন্তান উৎপাদন কারী হে নারী- কর্তব্য নির্বাহ করতে ঘরে ফিরে আসুন॥৮॥
📣আরোপ :৩ শূদ্রের শিক্ষা নিষিদ্ধঃ
মনুসংহিতার অধ্যায় ১০ এর ১২৬ এবং ১২৭ শূদ্রের শিক্ষার বিষয় কোনো আলোচনাই করেনি। সম্ভবত অপবাদ কারী মনে করছেন হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের শাস্ত্র জানে না। তাই যে কোনো একটা মন্ত্র বা নিজের শ্লোক তুলে দিলেও চলবে। চলুন কি বলছে স্মৃতি:
অর্থাৎ — (ধর্মীয় কর্মে) শূদ্রের কোনো পাতক দোষ নেই, তাঁদের কোনো সংস্কার নেই। তাঁদের ধার্মিক কাজে (মন্ত্র উচ্চারণ করার) কোনো প্রয়োজন নেই (শূদ্রের জন্য বিহিত পাকযজ্ঞাদি আছে), তাই কোনো প্রায়শ্চিত্য নেই।
অনেকের প্রশ্ন জাগতে পারে। তাহলে কি শূদ্রকে হিন্দু ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে? না। এর পরের মন্ত্র বলছে।
ধর্মকামী আচারপরায়ণ শূদ্রগণ ধার্মিক সজ্জনের মন্ত্র দ্বারাই অপরাধী হয় না বরং প্রশংসা পায়।
পাকযজ্ঞ কি: — আপনি দেখবেন, বিবাহে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যখন পুরোহিত যখন মন্ত্র পড়ে। তাঁকে অনুসরণ করে আমরাও তাঁর অনুকরণ করে মন্ত্র উচ্চারণ করি। কিন্তু কেউ যদি মন্ত্র উচ্চারণ না করে শুধু পুরোহিতের নির্দেশ অনুযায়ী ফুল, তিল, জল দেবতার উদ্যেশে দেয়। সেটাই পাকযজ্ঞ।
ব্রাহ্মণ যদি ভূল ভাবে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে, তবে ভূল উচ্চারণ করার জন্য ব্রাহ্মণের পাতক দোষ লাগে। কিন্তু শূদ্র যদি ভুল করে তাঁর সেই দোষ লাগে না।
৪ র্থ অধ্যায় এর ৮০ এবং ৮১ নম্বর শ্লোক তুলেও অপব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয় শূদ্রের অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরোপ করা হয়— "ব্রাহ্মণ কোন শূদ্রকে ধর্মোপদেশ দিলে তিনিও সেই শূদ্রের সাথে নরকে নিমগ্ন হবেনঃ।"
মনু বলছেন:
নীচ ব্যক্তি কে উপদেশ দেবে না, তাঁর সঙ্গে বসে বা উচ্ছিষ্ট খাবে না খাওয়াবে না। নিজ থেকে যেচে গিয়ে ধর্মোপদেশ দিবেন না, প্রায়শ্চিত্ত বা ব্রত সম্বন্ধে উপদেশ দিবেন না।
যে নীচ ব্যক্তিকে ধর্ম বলে বা ব্রতোপদেশ দেয়, সে তারই সঙ্গে অসংবৃত নামক নরকে নিমগ্ন হয়।
শূদ্রকে বলতে এখানে কোনো জাতির কথা বলা হচ্ছে না। বর্ণ ও জাত দুটো আলাদা জিনিস। যখন বলা হয় শূদ্রদের (शूद्राणां) তখন একটি গোষ্ঠী বা একই রকমের কিছু সমুহের লোকের কথা বলা হয়। কিন্তু যখন শূদ্রকে (शूद्रस्य) তখন কোনো একটি ব্যাক্তিকে বলা হয়।
এক বচনে শূদ্র কথার অর্থ হলো যে কোনো নীচ ব্যক্তি। কারণ কোনো ব্রাহ্মণও যদি তাঁর আচরণ দ্বারা অভদ্র, দাম্ভিক প্রতিপন্ন হয়। তবে সেই ব্রাহ্মণও শূদ্র বলে গণ্য হয়। সেরকম নীচ ব্যক্তিকে জ্ঞান দিলে, জ্ঞাতার কোনো উপকার হয় না। সেই নীচ ব্যক্তি উল্টে জ্ঞাতার অপমান করে বসে।
তাই বলা হয়েছে এরকম ব্যক্তি কে উপদেশ দেওয়া যাবে না। এটা নীতি শিক্ষা। কোনো আদেশ নয়।
📣 আরোপ :৪ গীতায় ফ্যাসীবাদ
শ্রীমদ্ভাগবদগীতা নিয়েও বিপরীত বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের মুর্খতার শেষ নাই। যেমন এই শ্লোকটি পড়ুন—
এখানে বলা হয়েছে, "মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন এমন মূঢ়, নরাধম, কখনও ঈশ্বরের শরণাগত হয় না।" মায়ার দ্বারা অপহৃত জ্ঞান তাই তারা জ্ঞানহীন খারাপ লোক।
তাদের মতে এই শ্লোকে বলা হয়েছে যারা কৃষ্ণের শরণাগত হয় না, তারা হল জ্ঞানহীন, খারাপ লোক এবং দুষ্কৃতকারী অসুর।
এখানে বলা কি বলা হয়েছে— যারা কৃষ্ণের আরাধনা করে না তারা খারাপ? না, স্পষ্টত বলা হয়েছে, "মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত" তারা জ্ঞানহীন, এবং দুষ্কৃতকারী অসুর ভাব সম্পন্ন।
এরপর চতুর্থ অধ্যায়ের অষ্টম শ্লোকটি উদ্ধৃত করে তারা বলে, যেহেতু যারা কৃষ্ণের শরণাগত হয় না, তারা খারাপ লোক তাই তিনি সেই দূষ্ট বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, মুসলমান এদের বিনাশ করার জন্য ঈশ্বর যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। সত্যিই কি তাই ?
শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ৪/৮ শ্লোক :
অনুবাদঃ "সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি (শ্রী নারায়ণ) যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।"
এখানে কোথাও বলা হয়েছে বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, মুসলমান এদের বিনাশ করার জন্য ঈশ্বর যুগে যুগে অবতীর্ণ হন?
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে, এক ছাত্র নদীর রচনা মুখস্ত করে এসেছে। পরীক্ষা হলে এসে জানতে পারলো গরুর রচনা এসেছে। তাই গরুর রচনা দিয়ে শুরু করে গরুকে নদীতে ফেলে দিয়ে নদীর রচনা লেখা শুরু করেছে। এদের উদ্দেশ্য এরকমই।
উপসংহার:
এখানে পরিষ্কারভাবে বিভিন্ন প্রাচীন হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, মূলত অপবুদ্ধির কারণে কিংবা শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে এমন ধারণাগুলি সমাজে ছড়ানো হচ্ছে। এখানে সঠিক প্রেক্ষাপটে শাস্ত্রের মর্মার্থ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এবং দেখানর চেষ্টা করেছি কিভাবে নরবলি, সতীদাহ, এবং শূদ্রদের শিক্ষা বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে।
এতে প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃত শাস্ত্রজ্ঞান এবং ধর্মীয় আচার-আচরণকে সঠিকভাবে অনুধাবন না করায় মানুষ অনেক সময় হিন্দু ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে, যা সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
0 Comments: