বেদব্যাস স্মৃতি ভ্রান্তি এবং অপব্যাখ্যা

আমরা যখনই কোন স্মৃতি শাস্ত্র পাঠ করি, এটা মনে রাখতে হবে যে, এই শাস্ত্র গুলো যাদের নামে লিখিত তাহারা নিজেরা ইহা লেখেন নাই।  যেমন মনুস্মৃতী মনু নিজে লেখেন নাই। মনু সেখানে বক্তা। তেমনি,  বেদব্যাস স্মৃতি বেদব্যাসের লেখা নয়। তিনি এখানে বক্তা। $ads={1}

দ্বিতীয় বিষয় হলো একটি শ্লোকের অর্থ ধরে কখনোই কোনো বিধান করা উচিত নয়। শর্ত এবং অবস্থার ভিত্তিতেই বিচার করা উচিৎ। যেমন মনে করুন, "যদি খাবারে ঝাল থাকে, তবে তাকে তীক্ষ্ণ খাবার বলা হয়। তীক্ষ্ণ খাবার খাওয়া বর্জন করা উচিত। রাতের বেলা তীক্ষ্ণ খাবার খেলে দুধ বা ঘি খাবে।"  

এখানে "তীক্ষ্ণ খাবার খাওয়া বর্জন করা উচিত।" এই শর্তে যে তীক্ষ্ণ খাবারে ঝাল আছে। এর অর্থ এই নয় যে ওই খাবার একেবারেই খেতে নেই। সেই ভাবেই শূদ্র বিষয়ক হিন্দু ধর্মে যে ভ্রান্তি আছে, সেটি শুধুই অবস্থার ভিত্তিতেই করা হয়। শর্ত গুলো বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। $ads={2}

যেমন, শূদ্র একটি জাতি। বিপ্র যখন বেদ ছেড়ে বহু কাল ধরে অন্য কর্ম করে। সেই ক্ষেত্রে সে ও তার পরিবার শূদ্র হয়ে যায়। অর্থাৎ সে বেদ চ্যুত হয়ে যায়। আবার, বিপ্র যদি ধী, জ্ঞান, অহিংসা, অসত্য ত্যাগ করে, তবে তাঁকে শূদ্রতুল্য গণ্য করা হবে। শূদ্ররা ঘৃণ্য নয়। তাই বলা হয়েছে : 

শূদ্র থেকেও শুভ বিদ্যাদি গ্রহন করবে। কূল ভ্রষ্ট উত্তম স্ত্রীকে বিবাহ করবে। এই কথাই মনু বলেছেন: —

অন্তদপি পরমংবিদ্যা স্ত্রীরত্ন দুঃকূলদপি

দ্বেষ, ঘৃণা, অহংকার, মোহ পতনের কারণ। তাই, যারা এই জাতিবাদ প্রচার ও সমর্থন এবং উস্কানি মূলক বার্তা প্রচার করে তাদের থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলা উচিৎ। এরকমই একটি আরোপ ব্যাস স্মৃতিকে ঘিরে আছে। তাই আপনাদেরও সামনে ওই শ্লোকটি তুলে ধরতে প্রসঙ্গ সহ আলোচনা করলাম। 

अथ वेदव्यासस्मृतिः
श्रीगणेशाय नमः 
प्रथमोऽध्यायः 

 अथ धर्माचरणा देशप्रयुक्त वर्ण षोडशसंस्कार वर्णनम् 

এখন ধর্ম পালন সম্পর্কীয় देशप्रयुक्त (স্থান ভেদে ব্যবহৃত ) ষোলটি সংকর বর্ণ ও তাদের অচার বর্ণনা করা হলো।

वाराणस्यां सुखासीनं वेदव्यासं तपोनिधिम् 
पप्रच्छुर्मुनयोऽभ्येत्य धर्मान् वर्णव्यवस्थितान् १ 

তপস্যার ভান্ডার বেদব্যাস বারাণসীতে আরামে উপবিষ্ট ছিলেন। ঋষিরা তাঁর কাছে এসে বর্ণ দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন:

स पृष्टः स्मृतिमान् स्मृत्वा स्मृतिं वेदार्थ गर्भिताम् 
उवाचाथ प्रसन्नात्मा मुनयः श्रूयतामिति २ 

সেই উজ্জ্বল স্মৃতিধর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন তিনি প্রসন্ন চিত্ত হয়ে বললেন, হে ঋষিগণ, শুনুন

यत्र यत्र स्वभावेन कृष्णसारो मृगः सदा 
चरते तत्र वेदोक्तो धर्मो भवितु मर्हति ३ 
প্রকৃতিতে যেখানেই কৃষ্ণসার হরিণ বিচরণ করে। সেখানে 
 বেদ উল্লেখিত ধর্ম আচরণ হবে।

श्रुतिस्मृतिपुराणानां विरोधो यत्र दृश्यते 
तत्र श्रौतं प्रमाणन्तु तयोर्दैधे स्मृतिर्वरा ४

যেখানে শ্রুতি(বেদ) স্মৃতি পুরাণের দ্বন্দ্ব দেখা যায়, সেখানে শ্রুতি(বেদ) প্রমাণ হিসেবে ধারন করা উচিত।

ब्राह्मणः क्षत्रियोवैश्यस्त्रयो वर्णा द्विजातयः श्रुतिस्मृतिपुराणोक्त धर्म योग्यास्तुनेतरे ५ 

শ্রুতি, স্মৃতি এবং পুরাণে উল্লিখিত দ্বিজত্য ধর্ম যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, তিনটি বর্ণর জন্য।

शूद्रोवर्णश्चतुर्थोऽपि वर्णत्वाद्धर्ममर्हति 
वेदमन्त्र स्वधा-स्वाहा-वषट्कारादि भिर्विना ६ 

 চতুর্থ শূদ্র বর্ণ, বর্ণের হয়েও, বৈদিক মন্ত্র, স্বধা, স্বাহা, বষঠ ইত্যাদি মন্ত্রের অনধিকারী।

विप्रवत्विप्रविन्नासु क्षत्र विन्नासु विप्रवत जातकर्माणि कुर्वीत ततः शूद्रासु शूद्रवत् ७

ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্রাহ্মণের মতো, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে ক্ষত্রিয়র মতো, জন্মের ভিত্তিতে বর্ণের দায়িত্ব পালন করা উচিত। তাই শূদ্রদের মধ্যে একজনকে শূদ্রের মতো আচরণ করা উচিত।

वैश्यासु विप्रक्षत्र्ता त्त्र भ्यां ततः शूद्रासु शूद्रवत् अधमादुत्त मा यान्तु जातः शूद्र अधमः स्मृतः ८ 

বৈশ্যদের মধ্যে যদি কোনও (विप्रक्षत्र्ता) ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের ধরনের কোনও গুণ না থাকে, তবে তারা সকলের সঙ্গে শূদ্রের মতো আচরণ করা উচিত। তাই শূদ্রদের মধ্যে একজনকে শূদ্রের মতো আচরণ করা উচিত। যদি একজন মানবজাতির মধ্যে শ্রেয়োনিষ্ঠ না হয়, তবে সে শ্রেয়োনিষ্ঠ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।


এরপর বলা হয়েছে কেন শূদ্রকে সর্বনিম্ন বা অধম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি কি তাঁর বংশ বা জাত বিচার করে? দেখুন ব্যাসদেবের বর্ণনায়:

ब्राह्मण्यां शूद्रजनितश्चाण्डालोधर्मवर्जितः कुमारीसम्भवस्त्वेकः सगोत्रायां द्वितीयकः ९

ব্রাহ্মণ, শূদ্র ও চন্ডালদের বংশে, ধার্মিক আচার-আচরণ বর্জিত, যদি কোন কন্যা জন্মগ্রহণ করে, তবে সে একই পরিবারে দ্বিতীয় স্ত্রীর কণ্য হিসাবে গ্রহন করা হবে।

ধরুন এমন একটি পরিবার আছে যেখানে পিতা ব্রাহ্মণ বর্ণের, কিন্তু তিনি ধার্মিক আচরণ সেই আর্থে নিষ্ঠাবান নন। তিনি ব্রাহ্মণের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নীতি ও কর্তব্যের বিপরীতে আচরণ করেন। এখন, "कुमारीसम्भवस्त्वेकः सगोत्रायां द्वितीयकः" (যদি কোন কুমারী জন্মগ্রহণ করেন) উক্তি অনুসারে তার একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে, তাকে একই পরিবারে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে জন্মগ্রহণকারী কন্যার সমতুল্য বলে গণ্য করা হবে। অর্থাৎ ওই কন্যার মান প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কন্যার মতো হবে না। 

এই প্রসঙ্গে, এর মানে হল যে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও, কন্যা সেই বর্ণের সাথে সম্পর্কিত সামাজিক মর্যাদা থেকে উপকৃত হবে না। কারণ তার পিতার আচরণ ব্রাহ্মণ্য নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাকে সামাজিকভাবে বিবেচনা করা হবে যেন সে একজন দ্বিতীয় স্ত্রীর কন্যা, যারা ঐতিহ্যগতভাবে অনেক সমাজে নিম্ন মর্যাদা ধারণ করে।

সুতরাং, বাক্যাংশটি ধার্মিক আচরণের গুরুত্ব তুলে ধরে এবং কীভাবে এটি একটি পরিবার এবং সমাজের মধ্যে ব্যক্তিদের সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে, তাদের বর্ণের পটভূমি নির্বিশেষে। তাই ধর্ম আচরণ করতে হবে। 

ब्राह्मण्यां शूद्र जनित श्चाण्डाल स्त्रिविधः स्मृतः वर्द्धकी नापितो, गोपाशापः कुम्भकारकः १०

এই বাক্যাংশটি মহিলাদের শ্রেণীবদ্ধ করে: যারা ব্রাহ্মণ নারীর গর্ভে জন্মেছে কিন্তু যাদের পিতা শূদ্র তাদের তিন উক্ত প্রকার চন্ডাল বলে গণ্য করা হয়। পুত্রহীন বৃদ্ধা নারী, পুত্রহীন পুরুষের স্ত্রী, দুধওয়ালার স্ত্রী এবং কুমোরের স্ত্রী।

এই ভূমিকা বা পেশাগুলি ঐতিহ্যগতভাবে নির্দিষ্ট জাতি বা সামাজিক গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত, যা নারীদের মধ্যে পেশার বৈচিত্র্য এবং সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে।।

 वणिक्किरातकायस्थमालाकारकुटम्बिनः 
एते चान्ये च वहवः शूद्रा भिन्नः स्वकर्मभिः 
चर्मकारो भटो भिल्लो रजकः पुष्करो नटः 
वरटो मेद चण्डाल दास स्वपच कोलकाः ११ 

ব্যাস স্মৃতির এই শ্লোকটি শূদ্রদের মধ্যে বিভিন্ন পেশা এবং সামাজিক অবস্থান বর্ণনা করে, যারা তাদের পেশার ভিত্তিতে একে অপরের থেকে আলাদা:

- বণিক (ব্যাবসায়ী)
- কীরাত (শিকারী)
- কায়স্থ (কেরানি ও করণিক )
- মালাকার (মালি)
- कुटम्बिन् (কাঠের কাজ করে যারা)

এটি অন্যান্য পেশা যেমন চর্মকার (চামড়া-শ্রমিক), भट (সৈনিক), भिल्ल (ধনুকধারী), রজক (ধোপা), पुष्कर (জেলে), নট (নর্তক), वरट (গোরু গাড়ি চালক), মেদ (তেলী), चण्डाल (আন্তজ বা মৃত সৎকার কারী), दास (সেবক), स्वपच (মদ বিক্রেতা), এবং কোলক (ঝুড়ি প্রস্তুতকারক)।

এই শ্লোকটি প্রাচীন সমাজে শূদ্রদের বিভিন্ন পেশা ও সামাজিক ভূমিকা তুলে ধরে.
एतेऽन्त्यजाः समाख्याता ये चान्येच गवाशनाः 
एषां सम्भाषणात् स्नानं दर्श ना दर्क वीक्षाणम् १२ 

एते - এই  अन्त्यजा - অন্তজ (যারা মৃত ব্যক্তির দেহ সৎকার কাজ করে) समाख्याता - সমভাবে স্বীকৃত ये: - ইহাদের : - এবং अन्येच - অন্যদের  गव- সঙ্গীত (বা স্ত্রী নর্তকী), आशना: - প্রেমিক,  एषां: - তাঁদের सम्भाषणात् - কথাবলা,  स्नानं - স্নান दर्श- দর্শন, ना - নেই,  दर्क - উপলব্ধি, वीक्षाणम् - কোন বীক্ষণ বা বিচারের প্রয়োজন নেই।

ভাবার্থ:— এই অন্তজ এবং তদ সমান স্বীকৃত সংগীত প্রেমীদের এবং অন্যদের কথাবলা, দেখা, স্নান করা বিষয়ে কোন বীক্ষণ ব্যতীতই উপলব্ধি করা যায়।

শব্দ যেটি থেকে "দর্ক" শব্দের অর্থ , "অনুভূত করা” বা “উপলব্ধি করা"। আবার, “দর্শ ” শব্দটির অর্থ দেখা। “দর্ষ না দর্ক বিক্ষণম" — “বিক্ষণ না করে দেখে উপলব্ধি করা যায়।”

সংস্কৃতে, এই মূল শব্দের বিভিন্ন রূপ দৃষ্টি, উপলব্ধি এবং পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত শব্দ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। অতএব "नादर्कवीक्षाणम्" (nadarvīkṣaṇam) অনুবাদ করেলে হয় "no sight or examination" .

সুতরাং, সম্পূর্ণ বাক্যাংশটির অর্থ হল "এই অন্তজ এবং সমান স্বীকৃত অন্য সংগীত প্রমীদের এক্ষেত্রে (নট) দের কথাবলা, স্নান বিধি, দেখেই উপলব্ধি করা যায়। এই বিষয়ে কোন বীক্ষণ বা বিচারের প্রয়োজন নেই।

বেদব্যাসকে বারাণসীতে ঋষিরা বর্ণ দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে ছিলেন। সেই ব্যখ্যা দিতে গিয়েই তিনি এমন কথা বলেছেন।

এই প্রসঙ্গে, এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে "শূদ্র" শব্দটি অবমাননাকর অর্থে ব্যবহৃত হয়নি বরং সামাজিক ভূমিকার উপর ভিত্তি করে একটি শ্রেণিবিন্যাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ঐতিহ্যগত হিন্দু সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে, শূদ্রদের চারটি বর্ণ বা সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে সর্বনিম্ন বলে মনে করা হয় এবং তারা সাধারণত সেবা-ভিত্তিক পেশার সাথে যুক্ত।

এই শ্লোকটি প্রাচীন ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান সামাজিক স্তরবিন্যাসকে প্রতিফলিত করে, যেখানে ব্যক্তিদের তাদের পেশা এবং অনুভূত আধ্যাত্মিক উৎকর্ষর ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল।


দেখুন উপরোক্ত অনুবাদে কিভাবে জাতি বিদ্বেষ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই শ্লোকে মাংস ভক্ষক, সূর্য দর্শনের মতো কোনো শব্দই নেই। যেহেতু সংস্কৃত ভাষা আমরা জানি না। তাই, সেই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সমাজে একটা বিরোধ ও অপ শিক্ষা ছড়ানো হচ্ছে। হিন্দুদের ভুল বুঝিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন করার চেষ্টা করা হয়েছে। না জানি এরকম ভাবে আরো কতো শত শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যারা অশৌচ থেকে শুচিতা দান করেন, সমাজের সকলের ভার বহন করেন তারাই শূদ্র নামে পরিচিত। সেই শূদ্রদের আমাদের হেয় করে দেখানো হয়। কারণ, আমরা তাঁদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাঁরা যে বশিষ্ট ঋষির বংশধর সেটা জানেন কি?

যাইহোক, ইতর মানসিকতার লোক গুলো কখনই দেশ ও দশের মঙ্গল চায় না। আমরা তাঁদের সুবুদ্ধি কামনা করছি। এই ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পটভূমি বিবেচনা করে, সমালোচনামূলক বোঝাপড়া এবং প্রাসঙ্গিক সচেতনতার সাথে এই ধরনের পাঠ্যগুলির অর্থ জ্ঞান করা অপরিহার্য। এই বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
InterServer Web Hosting and VPS

Copying content is illegal

Please refrain from copying content.