প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও যাগযজ্ঞ কি বৈদিক যুগের হিন্দুদের ভন্ডামী?

প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও যজ্ঞ দুটো মূলত একই জিনিস। তবে প্রয়োগ অনুসারে এদের প্রকৃতি আলাদা। ঈশ্বর সর্ব শক্তিমান। তিনি জগৎ উৎপন্ন করেছেন এবং পরিচালন করেছেন। তাঁর শক্তির কৃপা তে আমরা জগতকে জগত রূপে দেখছি। 

চোখ দিয়ে যেভাবে আমরা বাইরের বিশ্বকে দেখতে পাই। চোখ বন্ধ করে বিবেক দ্বারা নিজের মনকে বিক্ষন করলে আমরা ঈশ্বরের দর্শন করতে পারি।

pran-pratistha-yagya-yajna-vedic-hinduism-superstition-or-truth

যেভাবে পিতা ও মাতার মিলনে শিশুর জন্ম হয়। সেভাবেই ঈশ্বর এবং প্রকৃতির উপাদানে মাধ্যমে আমরা, আপনার, আমাদের সকলের জন্ম হয়েছে। গীতায় ভগবান বলছেন আমিই বীজ প্রদানকারী পিতা এবং আমিই জগত প্রসব কারী মাতা। 

আবারো তিনি বলেছেন আমিই সকল জীববের অন্তরে বসবাস কারী পরমাত্মা। অর্থাৎ তিনিই তাঁর সন্তান রূপে জগতের সকল প্রাণী। যেহেতু জগত তাঁর থেকে এসেছে। তিনিই জগতের অনু পরমাণুতে আছেন। 

ভৌত পদার্থ যেমন কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন বিশেষভাবে মিলিত হয়ে জৈব পদার্থ উৎপন্ন করে। সেই জৈব পদার্থগুলো নির্দিষ্ট শ্রেণীতে বিন্যস্ত হয়ে এককোষী ও বহুকোষী জীব উঠপন্ন করে। অনু পরমাণু থেকে শুরু করে কোষ বিন্যাস কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞান ল্যাবরেটরিতে এই ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোনো এককোষী জীব সৃষ্টি করতে পারেনি।

তবে একজন পুরোহিত কিভাবে মূর্তিতে সেই ঈশ্বরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে যিনি জগতের সৃজন করেছেন? এটা শুনতেও কানে লাগে। 

প্রাণ প্রতিষ্ঠা মূর্তিতে প্রাণ বা জীবন্ত করার পদ্ধতি নয়। বরং ওই মূর্তিতে সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্থাপন করা হয়েছে এরকম ভাবনা করা। 

আমরা মানুষ এবং আমরাও প্রকৃতির একটি উপাদান। বেদান্ত বলে এই প্রকৃতি আসলে মায়া বা অস্তিত্বহীন। ঈশ্বরের অস্তিত্বই মায়া কে প্রকট করে এবং মায়ার অস্তিত্বই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। প্রকৃতি না থাকলে ঈশ্বর থেকেও থাকত না। আমি এবং তুমি দুজনের মধ্যে কেউ একজন না থাকলে। তুমি নিজেকে আমি বা আমাকে তুমি বলতে পারতে না। 

তাই আমাদের ভাষায় ঈশ্বর হলেন আমাদের পিতা, প্রকৃতি আমাদের মাতা। প্রকৃতির শক্তি, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়ে তারই অংশ রূপে আমাদের শরীরে প্রাণশক্তি ও প্রাণবায়ু হিসেবে রয়েছে। সেজন্য অল্প হলেও সেই প্রাণবায়ু এবং প্রাণশক্তির ব্যবহার আমরা করি। 

প্রাণ বায়ু

প্রত্যেকটি জীব বেঁচে থাকার জন্য প্রাণবায়ুর উপর নির্ভরশীল। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই প্রাণবায়ুকে অক্সিজেন বলা হয়। কিন্তু প্রাণ কথার তাৎপর্য অনেক গভীর। উপনিষদে এক আত্মা বা ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। 

আপাত দৃষ্টিতে আমরা ইহাকে অক্সিজেন বলবো। কারণ এখানে প্রাণ নামক বায়ুর কথা বলা হচ্ছে। এই গ্যাসীয় পরমাণু শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে। আপান নামক এক বায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষ বা বিরোধ হওয়ার ফলে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। 

বক্ষ কোটর ও উদর প্রকোষ্ঠ যথাক্রমে প্রাণ ও আপন বায়ুর আবাগোমন স্থান। জীবিত ব্যক্তির দেহে এটি অতিক্রম করে না। মৃত্যুর সময় এরা পরস্পরকে ভেদ করে বিপরীত দিকে বেরিয়ে যায়। আজকের ভাষায় ডায়াফ্রামের কার্য ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যায়।

প্রাণ, আপান, সমান, উদানব্যান নামক মোট পঞ্চ বায়ুর উল্লেখ হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র যেমন শিব পুরাণের বায়বীয় সংহিতায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও যোগ ও বিভিন্ন উপনিষদে পঞ্চ উপপ্রান নামক বায়ুর উল্লেখ করা হয়েছে। এই পঞ্চ উপপ্রাণ (নাগ, কূর্ম, দেবদত্ত, ক্রিকাল ও ধনঞ্জয়)।

এই সকল বায়ু গুলো আমাদের শরীরে শ্বাস-প্রশ্বাস সহ মল, মূত্র, বীর্য পরিবহনে তথা শক্তির ব্যবহারে দেহ যন্ত্রকে সাহায্য করে। মূলত প্রাণ বায়ুই ভিন্ন ভিন্ন রূপে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ক্রিয়া করে। একেই প্রাণ শক্তি বলা হয় এবং এই প্রাণ শক্তি ধারি জীবেদের প্রাণী বলা হয়।

প্রাণ শক্তি

প্রাণীদের মধ্যে প্রাণ শক্তি আছে তাই তাঁরা জীবিত। উদ্ভিদের মধ্যেও তদ অনুরুপ প্রাণ শক্তি আছে তাই তার মধ্যে স্পন্দন আছে। তাই এরা জীবিত। জড় পদর্থ যেমন কাঠ, পাথর, মাটি, জল, এগুলোর মধ্যেও প্রাণশক্তি আছে। কিন্তু চেতনা বা  স্পন্দন না থাকায় তারা মৃত। 

প্রাণীরা খাদ্য, বংশ বিস্তার এবং আত্মরক্ষার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। কিন্তু উদ্ভিদ এক স্থানে থেকেই নিজের অঙ্গ (মূল, কাণ্ড বা লতা ইত্যাদি) বা রেনুকে অন্য স্থানে অন্য স্থানে প্রেরন করার জন্য বিভিন্ন অভিযোজন গত শারীরিক পরিবর্তন করে। পাথরের সেই ক্ষমতা নেই।

এই চেতন প্রানীরা "আমার নাম অমুক, আমার পরিবার, আমার ঘর, আমার বুদ্ধি, আমার মন, আমার চেতনা" — এই আমিত্ব বোধ আছে। 

উদ্ভিদের থাকলেও সেই বোধ থাকতে পারে, কিন্তু সে সেই বোধকে প্রাণীর মতো ব্যক্ত করতে পারে না। উদ্ভিদও উত্তেজনায় সারা দেয়। যেমন, লজ্জাবতী গাছ স্পর্শ করা মাত্রএ পাতা গুটিয়ে নেয়।

 এই পাথরের মধ্যে কি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? 

প্রাণ প্রতিষ্ঠা আস্তিক দৃষ্টিকোণ।

দেবতার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূর্তির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলে মুর্তি কি জীবিত হয়ে যায়? মুর্তি কি কথা বলতে পারে? মূর্তি কি নিজের আত্ম রক্ষা করতে পারে? এই সব কিছুর জবাব আমরা এখানে আলোচনা করবো। তাঁর আগে বিজ্ঞানের কিছু তথ্য প্রযুক্তি সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরতে চাই। যাতে করে আমার কথাগুলো আধুনিক বুদ্ধি দ্বারা বিবেচনা করতে পারেন।

পাথর উত্তেজনায় সারা দেয় না বলেই পথেরর মধ্যে কোনো চেতন ক্ষমতা নেই। কিন্তু আগেই বলেছি পাথরে চেতনা নেই তবে প্রাণ আছে। কিভাবে?

মাটি, পাথর ও কাঠ এই তিনটি উপাদানের মধ্য থেকেই আমরা অর্থাৎ জীব কুল নিজের জীবনী শক্তিকে সংগ্রহ করি। পাথর বিচূর্ণ হয়ে খনিজ লবণ যুক্ত বালি তৈরি হয়। মৃতদেহ পচে মাটি তৈরি হয়। সেই সকল বালি, কাকর খনিজ লবন বহু বছর মাটির নিচে বহু বছর ধরে ধরে চাপ ও তাপে পাথরে পরিণত হয়। 

সেই মাটি থেকেই উদ্ভিদের মূল খাদ্য রস ও শোষণ করে। সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে, বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইদের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গ্লুকোজ নামক খাদ্য উৎপন্ন করে। 

আধুনিক বিজ্ঞান বলছে এই গ্লুকোজে সূর্যের শক্তি ইনঅর্গানিক ফসফেট এডিনোসিন বেস পেয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এডিনোসিন ট্রাই ফসফেট ATP নামক একটি জৈব অনুর মধ্যে সঞ্চিত থাকে। সেই জৈব অনু ATP পাতার কোষের মাইটোকনড্রিয়া নামক কোষ-অঙ্গানুর মধ্যে আবদ্ধ থাকে। প্রথম শ্রেনীর খাদক উদ্ভিদের ফল , পাতা বা কান্ড খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদের দেহে ওই ATP সঞ্চয় করে। এই ATP -র শক্তিকে পাওয়ার জন্যই, মাংসাশী প্রাণীরা অন্য পশুকে মেরে খায়।

প্রাণীদের শ্বাস প্রশ্বাস, হৃদ স্পন্দন, দৌড়-ঝাপ, কথাবার্তা ইত্যাদি ক্রিয়া করার সময় ওই ATP, জ্বালানি হিসেবে কোষের মধ্যে শক্তি উৎপাদন করে। ইহাকেই আমরা প্রাণশক্তি বলি। 

প্রাণ বায়ুর অনুপস্থিতিতে এই প্রাণশক্তি কাজ করে না। কারণ, ওই সূর্যের শক্তির ব্যবহার হলে দেহে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরী হয়। সেই কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃশ্বাসের মাধ্যমে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। 

অনুরুপে কাঠ কয়লা ইত্যাদি জানালে যে তেজ উৎপন্ন হয়। সেটাও কার্বন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ার কারণেই হয়। এই বিক্রিয়া যখন জীব দেহে ঘটে তখন তাঁকে শষন প্রক্রিয়া বলা হয়। কাঠ কয়লা জ্বালালে ওই বিক্রিয়াকে দহন বলা হয়। 

মৃতদেহের মধ্যে চেতনা থাকে না। মৃতদেহে হাত মুখ পা, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, পাকস্থলী, সবকিছু থাকতে। তার মুখে ফু দিলে সে নিশ্বাস প্রশ্বাসও করবে। বুকে চাপ দিয়ে হৃদপিন্ডের মাধ্যমে ও রক্ত চলাচল করানো যেতে পারে। কিন্তু আপন বায়ুর অভাবে তার মধ্যে কোনো সয়ংক্রিয়তা থাকে না। তাই মৃতকে জীবিত করা যায় না। মৃত জীব তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। 

হিন্দু পুরোহিত সর্বত্র বিদ্যমান সেই প্রাণ বা ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করে, যেন তিনি ওই পাথরের মূর্তিতে এসে হাজির হন এবং পূজা গ্রহণ করেন। মূর্তিতে যতক্ষণ প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হয়, ততক্ষণ সেটি একটি ভাস্কর্য। 

"ইহাগচ্ছ ইহতিষ্ঠ সন্নিধেহি, ইহ সন্নিরুধ্যস্ব অত্রাধিষ্ঠানং কুরু মম পূজাং গৃহাণ", ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা ইষ্ট দেবতাকে আমন্ত্রণ করা হয়। 

মানুষের এই আহ্বানে কি ঈশ্বর সত্যই ওই পাথরের মূর্তিতে এসে জীবিত হয়ে যায়?

যদি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে আহ্বান করার এই সামান্য ক্ষমতা না থাকে। ঈশ্বর মানুষের আহ্বানকে যদি স্বীকার না করে। তবে মুসলমানের আযান, খ্রিস্টানদের প্রার্থনাও বৃথা চেষ্টা বা অর্থহীন মনে করতে হবে। তাহলে সকল আস্তিকদের ঈশ্বর যাদের তারা আল্লাহ, গড বলে। এই সবই ক্ষমতা হীন গণ্য করতে হবে। 

নাস্তিকরা দৈব কৃপায় আস্থা রাখে না। যদি আপনি নাস্তকি হন, তাহলে আপনার জবাবও আমি দেব।

প্রাণ প্রতিষ্ঠার নাস্তিক যুক্তি ।

যেহেতু নাস্তিকেরা ঈশ্বর কৃপা, ঈশ্বর ক্ষমতা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না। নাস্তিকদের চোখে এই সমস্ত প্রার্থনা পূজার কোনো অর্থ নেই। প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং প্রাকৃতিক বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাঁদের কাছে গ্রহযোগ্য। তবে এদের categorically চিহ্নিত করে বলতে হবে। জগা খিচুড়ি চলবে না।

এই নাস্তিকরা তিন প্রকার। প্রথমত, এক প্রকার নাস্তিক আছে যারা ঈশ্বর নাই এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। দ্বিতীয়ত, আরেক প্রকার নাস্তিক আছেন যারা ঈশ্বর নাই কিন্তু প্রাকৃতিক বা মহাজাগতিক কোন শক্তি আছে এমন বিশ্বাস করে। অন্তিম প্রকার হলো তারা যারা বলে, "ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু যেহেতু আমি নিজে দেখিনি, তাই বিশ্বাস করি না।"

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় প্রকার নাস্তিক বলা যায়, কারণ তারা বেদের দেবতা বা ঈশ্বরের কর্তৃত্ববাদের সিদ্ধান্ত বিশ্বাস করে না। তাঁদের মতে বেদে যে ভাবে জগত সৃষ্টি হয়েছে বলা হয়েছে সেই দেবতা শিকার করে না। তারা ওই শক্তিকে প্রকৃত তত্ত্ব হিসেবে শিকার করেন। তাঁদের মতে, "পদার্থ নিজের মধ্যেই প্রকৃতির গুনে জগত সৃষ্টি করেছে। এর জন্য কোনো দেবতা বা কর্তার কর্তৃত্ব নেই।" বৌদ্ধরা কর্তৃত্ব বাদ গ্রহণ করে না। তাদের কাছে এই সব দেবী দেবতারা তত্ত্ব।

পাথরের মূর্তিতে ঈশ্বর থাকতে পারে, মন্ত্রের শক্তি থাকতে পারে, ভক্তির দ্বারা ঈশ্বর বশীভূত হয় এইসব বৌদ্ধদের কাছে কাল্পনিক। তারা বুদ্ধ অর্থাৎ জ্ঞান বা বোধের উপাসক। বৌদ্ধরা হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধ নয়, তারা বেদ বিরুদ্ধ।

তবে এই বেদ বিরোধিতা এক সময় চরমে পৌঁছে যায়। যখন চার্বাক ও বৌদ্ধদের বিশ্বাস এক হয়ে যায়। বুদ্ধ বলে গেছেন কোনো প্রাণীর প্রতি হিংসা করবে না। কিন্তু, বৌদ্ধরা নিজেরা পশু হত্যা না করলেও কেউ যদি মাংস এনে দেয়। তবে তারা সেই মাংস খায়।

কিন্তু পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অ্যাথিস্টরা এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শিক্ষাকেই অস্বীকার। তাঁরা প্রথম প্রকারের নাস্তিক। 

হিন্দুরা অগ্নিতে হবি দান করেন। বেদের প্রথম মন্ত্র "অগ্নিমিড়ে পুরোহিতাম..." অগ্নিকে পুরোহিত এবং হবি বাহক, হিসেবে পরিচয় করানো হ্চ্ছে। বেদ ও উপনিষদে অগ্নিকে দেবতাদের জিহ্বা রূপেও বর্ণনা করা হয়েছে।  

এগুলো কি শুধুই মানুষের কল্পনা? আসুন, বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা বুঝিয়ে দিই। আগুনে কোন কিছু দাহন করলে সেই বস্তুর মধ্যে থাকা শক্তি প্রকৃতিতে ফিরে যায়। এর ফলে বস্তুটির ভর কমে যায়। একে ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র হিসেবে আমরা ভৌত বিজ্ঞানে পড়েছি।

সেই শক্তি যা কাঠের মধ্যে সঞ্চিত ছিল, ঘি এর মধ্যেও সঞ্চিত ছিল। সেটি সূর্যের ওই ATP। দহনের ফলে যে তেজ ও আলো উৎপন্ন হয়েছে সেটি সূর্যেরই অগ্নী। 

দহনে যে তাপ উৎপন্ন হয়েছে, সেটি বায়ুর মধ্যে উর্ধ গতিশক্তি রূপে মেঘ ও বায়ুর চলনের জন্য দায়ী। এই জন্য আগুনের নাম অগ্নি। অগ্নী অর্থাৎ উর্ধ গতি যুক্ত। উষ্ণ বায়ু উপরে উঠে যায়। শীতল বায়ু সেই খালি স্থান দখল করতে আসে। এভাবে অগ্নী ও বায়ুর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। 

এই বায়ু প্রবাহ হলেই জলীয় বাষ্প পূর্ণ মেঘের প্রবাহ হয়। এখানেই হিন্দুদের বরুণ দেবতা ও পবন দেবতার ভূমিকা। মেঘে প্রবাহ হলেই, স্ট্যাটিক ইলেকট্রিক বা স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয়। এর ফলে বজ্রপাত হয়। বজ্রপাত হলে, বাতাসে কম্পন হয়। বাতাসে কম্পন হলে, জলীয় কণাগুলো একত্রে মিলিত হয়ে বড় বড় কনায় পরিণত হয়। এর ফলে বর্ষা হয়। মেঘ বা বৃত্তা জলকে সঞ্চয় করে রেখেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র বজ্র দ্বারা বৃত্তাসুর বধ করেছিলেন। এটাও বেদের একটি মন্ত্র আছে। "ইন্দ্রো অহিম্ অরণ্যসু বধিত, বৃত্রং বধিত..."

বর্ষা হলেই উদ্ভিদ রস পায়। সেই রস মাটি থেকে শোষণ করে বীজ মাটি ভেদ করে উদ্ভিদ রূপে আবির্ভূত হয়। উদ্ভিদ ফল ও অন্ন উৎপাদন করে। সেই অন্নে সূর্যের শক্তি সঞ্চিত থাকে। সূর্যের শক্তিই সমগ্র জীবনকে চালিত করে। সূর্যকে সকল জীবের আত্মা বলা হয়েছে — "সূর্য আত্মা জগতঃ তস্থুষশ্চ।"(ঋগ্বেদ ১.১১৫.১) (সূর্য হলো সমস্ত জগত এবং স্থির ও চলমান সমস্ত কিছুর আত্মা।)

তাই সূর্য, আগুন, মাটি, জল, বৃক্ষ, এই সব কিছুইকে হিন্দু এবং অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগুলো দেবতা রূপে পূজা করে আসছে। তাই মূর্তি পূজা, অগ্নি পূজা, বৃক্ষ পূজা, পশু পূজা, নারী পূজা, গুরু পূজা , অতিথি পূজা গুলো ভন্ডামি নয়। এগুলো আসলেই ইশ্বরের প্রকৃত সেবা। 

বিতর্ক যুক্তি:

আজকাল পেট্রল পুড়েও কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। দিন দিন পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই যুক্তিতে বায়ুপ্রবাহও বেড়ে যাওয়া উচিত। বর্ষা হওয়া উচিত। ঈশ্বরের নিমিত্বেই পূজা করতে হবে এর কি যুক্তি?

একদম সঠিক, কিন্তু একটু পার্থক্যও আছে। সেটা হলো সংকল্পের অভাব। সংকল্প বা intention ছাড়া কোনো কাজ সুফল দেয় না। পেট্রোল পুড়ে যে কার্বনডাই অক্সাইড তৈরী হয়, তার ফলে যে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে। সেটা মানব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। দাবানলে হাজার হাজার হেক্টর বন জ্বলেছে সেটাও ওই একই ক্যাটাগরিতে আসে।

আপনি তৃষ্ণা মেটাতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে এক গ্লাস জল খাচ্ছেন। আপনি intentionally তৃপ্ত হতে জল খেয়েছেন। কিন্তু আপনাকে যদি জোর করে গ্লাসের পর গ্লাস জল খাইয়ে খাইয়ে পেট ভরানো হয় বা জলের বালতিতে মাথা ডুবিয়ে দেওয়া হয়। একটা সময় আসবে আপনি আর জল খেতে পারবেন না। বমি করে ফেলবেন।  প্রকৃতির সাথেও সেই একই ঘটনা ঘটছে। 

যদি বৃষ্টির প্রয়োজনে সংকল্প করে যজ্ঞ করা হয়। প্রকৃতির আবহাওয়া সেই সংকল্প যজ্ঞের দ্বারা তৃপ্ত হলে, প্রকৃতিতে তার চিহ্ন প্রকট করে। প্রকৃতি তাঁর প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে সঠিক সময়ে বারি বর্ষণ করে। অন্যথা হলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয়। 

প্রয়োজন ছাড়াই প্রকৃতির উপর অতিরিক্ত কার্বনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে প্রকৃতিতে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে যে,  বর্ষা কালে অতিবৃষ্টি, গ্রীষ্ম কালে প্রচন্ড উষ্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। যানবাহন ও কলকারখানার কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি গ্যাস শুধু উদ্ভিদ কেই নয়। এই প্রকৃতির কোলে বসবাসকারী সকল প্রাণী ও জিব কুলকে প্রভাবিত করছে।

এই ধরনেরই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল মিশরে। মিশরের রাজা (ফ্যারাও) প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে প্রজাদের ওপর অনৈতিক ভাবে অত্যাচার আবিচার করেছিলো। নিজেকে ইশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রকৃতির শোষন করেছিলো।

তাই সেখানে প্রকৃতি নিজের বিভীষিকা প্রকট করেছিল। সেখানকার ইকো-সিস্টেম, একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যারা বুদ্ধিমান ছিল তারা সেই স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। এই ঘটনাকে ইতিহাসে Exodas বলা হয়। যারা নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে পেরেছিল তাঁদের বংশরাই ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলিম।

অর্থাৎ, প্রকৃতির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা আছে। সেই বুদ্ধিমত্তাকে হিন্দুরা সফল ভাবে ব্যবহার করতে হোম বা যজ্ঞ করে। 

পরিশিষ্ট:

অতএব, প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও যাগ-যজ্ঞ হিন্দুদের ভন্ডামী বা কুসংস্কার নয়। হিন্দুদের তথা প্রাচীন ধর্মগুলো শুধু বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে তৈরী হয় নাই। বহু বছরের অভিজ্ঞ ও শিক্ষার দ্বারা গঠিত হয়েছে। ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন, এই কথার অর্থ এমন নয় যে কোনো একজন ইশ্বর আছেন আর কেউ নেই। এর অর্থ হলো একমাত্র তিনিই সব কিছুতে আছেন, তিনি ছাড়া কোনো কিছুই নেই।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন
Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds

Advertisement

Hostinger Black Friday Sale – Starting from ₹129/mo Promotional banner for Hostinger Black Friday deal: AI website builder, free domain, extra months. Pre-book now. Black Friday Sale Bring Your Idea Online With a Website From ₹129.00/mo + Extra Months & Free Domain Pre-Book Now HinduhumAds