তর্ক, বিতর্ক এবং কুতর্ক নির্ণয়।
ঋষি গৌতম ন্যায় দর্শনের প্রণেতা। আমরা যাহাকে আজ ইংরেজী ভাষায় লজিক বলি, সেটাই ন্যায় বলে কথিত ছিল। এমনটি নয় যে বিদেশী দার্শনিকরা আমাদের থেকে ন্যায় শাস্ত্র কপি করেছে। পাশ্চাত্য দেশেও তারা নিজেদের তৈরী এই ন্যায় বা লজিক ব্যাবহার করতো। আমাদের ন্যায় শাস্ত্র গুলোর কথা আমরা জানি না। তাই পাশ্চাত্য দেশের লজিক বহুল প্রচলিত আছে।
আমরা এই ব্লগে পাশ্চাত্য আধুনিক লজিক ও প্রাচীন ঋষী প্রণীত ন্যায় শাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করছি। আশা করছি সকলের ভালো লাগবে। আজকের ব্লগের বিষয় সূচি নিম্নে দেওয়া হলো:
ভূমিকা:
লজিক দুটি উপকরনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়— সত্য এবং মিথ্যা। হয় কোনো ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য হবে, নতুবা মিথ্যা। সত্য বা মিথ্যার মাঝা মাঝি আটকে থাকলে সেটাকে সংশয় বলা হয়। যখন কেউ একটি দাবি সমর্থন করে, ওই দাবির যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ বা প্রতারণামূলক হলে তাকে ফ্যালাসি বা কুতর্ক বলে।
উদাহণস্বরূপ, ঈশ্বর আছে এবং ঈশ্বর নেই। উভয় দাবি সত্য না মিথ্যা এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতে পারে। ঈশ্বর নেই এই দাবির যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ হবে যখন কেউ বলবে যেহেতু আমি ঈশ্বর দেখিনাই তাই সে নেই।
প্রমাণ:
প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং আপ্ত এই তিনটি প্রমাণ।
যা ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখা যায় ও দেখানো যায় সেটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কোনো কিছুর লক্ষণ দেখে প্রমাণের সাক্ষ্য অনুমান করা হয় তাকে অনুমান প্রমাণ বলা হয়। কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠত উৎস দ্বারা যখন কোনো কিছু প্রমাণ করা হয় সেটি আপ্ত প্রমাণ।
তর্ক, বিতর্ক এবং কুতর্ক
মেঘের রং সাদা। এর প্রমাণ চাইলে কেউ তাহা প্রমাণ করতে অন্য কোনো উদাহরণ বা যুক্তির আশ্রয় নেবে না। সে খোলা আকাশের নীচে গিয়ে দাঁড়াবে। সে প্রত্যক্ষ ভাবেই জানতে পারবে। কিন্তু সাদা রং -কে সাদা কেন বলা হয়। এরকম প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। কারণ, সাদা রঙ হলো ভিত্তি। একটা তর্ককে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
দুধের রং, মেঘের রং, চুনের রং সমান। এটা প্রত্যক্ষ তাই চুনের রং সাদা হলে দুধের রং, মেঘের রং সাদা হবে।
এখানে চুনের রং ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই ভিত্তিতে দুধ ও মেঘের রং নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। এর প্রমাণ প্রত্যক্ষ এবং অনুমান করা হয়েছে। এটি একটি সঠিক সমাধান। এবার একটা কু-তর্কের উদাহরণ দেখুন:
দরজাটা অর্ধেক খোলা আছে, অর্থাৎ দরজাটা অর্ধেক বন্ধ আছে। তাই দরজাটা সম্পুর্ণ খোলা আছে, অর্থাৎ দরজাটা সম্পুর্ণ বন্ধ আছে।
এখনে ভিত্তিটি কেই নিজেই নিজের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এটি একটি কুতর্ক।
উক্ত উদাহরণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি প্রত্যেক তর্কের তিনটি প্রধান অংশ আছে। প্রথমত একটি ভিত্তি থাকতে হবে, একটি বা অনেক বিকল্প থাকতে হবে এবং একটি সমাধান থাকতে হবে। মূলত বিকল্প গুলোকে বুঝে তার ভিত্তিতেই তর্ক এবং কুতর্ক নির্ণয় করা হয়। তর্ককে পরাস্ত করতেই উপরোক্ত তিনটি প্রমাণ আশ্রয় নেওয়া হয়। তাহলে তর্কের উদ্দেশ্য কি?
তর্কের উদ্দেশ্য:
তর্কের উদ্দেশ্য হলো সমাধান নির্ণয় করা। যখন কোনো তর্ক সমাধান নির্ণয় করে, তখন তর্ক সমাপ্ত হয়। নতুবা তর্ক, বিতর্ক এবং কুতর্ক এভাবেই অবিরাম চলতে থাকে। যে সম্পর্কে আপনি জানেন না, বোঝেন না, সেই বিষয়ে যদি আপনি কথা বলেন, তবে আপনি কুতর্ক করবেন। বিষয় মূল মোদ্দা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য বিষয়ে চলে যাব। ফলাফল দাঙ্গা, লড়াই ও মানহানি। তাই আমাদের দেশে যখন তর্ক সভা অনুষ্ঠিত হতো সেগুলি কিছু কিছু নিয়ম মেনে হতো।
তর্কের নিয়ম:
তর্কের প্রথম নিয়ম
অজ্ঞানী ও মূর্খের সঙ্গে তর্ক করতে নাই। কারণ যার জ্ঞান নাই তাকে পরাজিত করে কোনো কৃতিত্ব অর্জন হবে না। সে জল্পনা করবে কিন্তু হার মানবে না।
তর্কের দ্বিতীয় নিয়ম
বিতন্ডা করার জন্য তর্ক করতে নেই। বিতন্ডা হলো এমন এক জিনিস যেখানে কেবমাত্র এক পক্ষ প্রতিপক্ষের ত্রুটি গুলো চিহ্নিত করে কিন্তু নিজের পক্ষ বা Stand রাখে না।
তর্কের তৃতীয় নিয়ম
তর্ক সব সময় বাদ-বিবাদের মাধ্যমে করতে হয়। ইহাকে Healthy Discussion বলা হয়। যেখানে একটা বিন্দুতে কোনো সমাধান নির্ণয় করা সম্ভব হবে এবং পরাজিত ব্যক্তি বিজেতার বশ্যতা স্বীকার করবে। উত্তম তর্ক জ্ঞান বর্ধনের জন্য হয়। এর দ্বারাই সমাজে জ্ঞান ও সুশিক্ষা বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও আরো তেরো প্রকার নিয়ম ও নিষেধ আছে। যা এখানে আলোচনা করা হলো না। কারণ বিষয় অনেক বড় হয়ে যাবে, এবার পাশ্চাত্য দেশের লজিক নিয়ে কথা বলি।
পাশ্চাত্য দেশের ফ্যালাসি বা কুতর্ক গুলি মূলত নিম্ন লিখিত বিন্দুতে আলোচনা করা হলো। ফ্যালাসি বা কুতর্ক তিন প্রকার: 1.ফর্মাল ফ্যালাসি 2. ইনর্মাল ফ্যালাসি এবং 3. চক্রাকার ফ্যালাসি
এখানে উদাহরণ দেওয়া হল:
ফর্মাল ফ্যালাসি বা আনুষ্ঠানিক কুতর্ক
ফর্মাল ফ্যালাসি গুলি হল একটি যুক্তির যৌক্তিক কাঠামোর ত্রুটি যা তর্ককে অবৈধ করে। এখানে কিছু উদাহরণ আছে:
A. পরিণাম নিশ্চিত করা:
যদি P তাহলে Q হবে. Q হলেই P হবে. (অবৈধ)। এর বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে সেটা উপেক্ষা করা হয়। - উদাহরণ: যদি বৃষ্টি হয়, মাটি ভেজা থাকবে। মাটি ভেজা আছে, তাই বৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি নির্দিষ্ট ও সীমিত কাঠামোর মধ্যে তর্ককে বেধে রাখা হয়েছে। এর বাইরেও যে কোনো কারণ থাকতে পারে, সেটা বলা হচ্ছে না।
মাটি অন্য অনেক কারণেই ভিজতে পাড়ে। কেউ জল ঢেকে দিলেও মাটি ভিজতে পাড়ে। জলের পাইপ ফেটে মাটি ভিজতে পারে। এই রকম পরিণাম নিশ্চিত করা কুতর্ক খুবই সাধারণ। অনেক ডিবেটে এরকম কুতর্ক উপস্থাপন করা হয়।
B. পূর্ববর্তীকে অস্বীকার করা:
যদি P সত্য, তাহলে Q সত্য। যেহেতু P নয়, তাই Q নয়। (অবৈধ) - উদাহরণ: যদি রোদ হয় (P), তাহলে খেলা হবে (Q)। এটা রৌদ্রোজ্জ্বল নয় (P নয়), তাই আমি খেলা হবে না।
C. মিথ্যা দ্বিধা (মিথ্যা দ্বিধাবিভক্তি):
আরও উপস্থিত থাকলে শুধুমাত্র দুটি বিকল্প উপস্থাপন করা। - উদাহরণ: "হয় আপনি আমার মতামত সমর্থন করেন, নতুবা আপনি অগ্রগতির বিরুদ্ধে।"
এগুলি কেবল কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ভুল। প্রতিটি যুক্তির যৌক্তিক কাঠামোতে একটি ত্রুটি জড়িত।
ইনফর্মাল ফ্যালাসিস বা অনানুষ্ঠানিক :
যুক্তির বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গে ত্রুটি।
অনানুষ্ঠানিক ভ্রান্তি বা ইনফর্মাল ফ্যালাসিস গুলি যুক্তিযুক্ত কাঠামোর পরিবর্তে একটি যুক্তির বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গে ত্রুটি। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল:
অ্যাড হোমিনেম:
যুক্তিকে সম্বোধন করার পরিবর্তে তর্ককারী ব্যক্তিকে আক্রমণ করা।
উদাহরণস্বরূপ, "তার কথা শুনবেন না; সে কেবল কিশোরী।" "তার কথা শুনবেন না; তিনি কেবল একজন অন্ধ ভগত"
স্বর্ব সাধারণীকরণ:
অপর্যাপ্ত বা পক্ষপাতদুষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে একটি উপসংহার আঁকা .উদাহরণ: "আমি সেই শহরের দু'জন লোকের সাথে দেখা করেছি, এবং তারা দুজনেই অভদ্র ছিল। তাই সেখানে প্রত্যেকেই অবশ্যই অভদ্র হবে।"
স্ট্র ম্যান:
আক্রমণ করা সহজ করার জন্য কারও যুক্তিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা বা অতিরঞ্জিত করা। উদাহরণ: "অমুক জাতির লোকেরা আমাদের শত্রু, ওরা বন্দুক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ চায় আমাদের সব অধিকার কেড়ে নিতে চায়।"
সার্কুলার রিজনিং (অদৃশ্য হাতি) :
এই ক্ষেত্রে উপসংহার-কে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা। উদাহরণ: "এই ঘরে একটা অদৃশ্য হাতি আছে, আমি ছাড়া কেউ তাঁকে দেখতে পাবে না। সে নিজে এই কথা বলছে, এর প্রমাণ এই বই। সে যে বলেছে আমি তাহা লিখেছি।"
- প্রশ্ন - অদৃশ্য হাতি আছে এর প্রমাণ কি?
- উত্তর- "এই বই"
- প্রশ্ন - এই বইটি সত্য এর প্রমাণ কি?
- উত্তর -"হাতিটি নিজে এই কথা বলছে।"
- প্রশ্ন - হাতিটি কথা বলেছে তাহা আমি বিশ্বাস করবো কেন? কি প্রমাণ আছে হাতিটি বাস্তব?
- উত্তর - "এই বই তার প্রমাণ যা হাতিটি বলেছে।"
এইরকম যুক্তি বা রিজনিং হলো সার্কুলার রিজনিং। এখন ওই অদৃশ্য হাতির ওপর যদি আপনি সত্য বলে বিশ্বাস করেন এবং যদি ওই অদৃশ্য হাতির লিখিত বই যদি শীতের রাতে ঠান্ডা জলে স্নান করতে বলে। তাহলে আপনি সেটাই করবেন। এই সার্কুলার রিজনিং মূলত ধর্মীয় আস্থার সঙ্গে জড়িত। এর থেকেই কুসংস্কার ও কুপ্রথা জন্ম নেয়।
তাহলে কি ঈশ্বরের বিশ্বাস করতে নেই?
বিশ্বাস ও আস্থা এই দুটি আলাদা আলাদা শব্দ। এদের অর্থও আলাদা। আস্থা হলো বিশ্বাসের প্রথম ধাপ। আস্থা হলো এমন কিছু যা আপনি দেখেননি বা অনুভব করেননি অথচ আপনি অনুমান করেন সেটি সত্য। যেমন: ইশ্বর আছেন বা কলকাতায় ট্রাম চলে। ইশ্বর আছেন এটি একটি আস্থা। কারণ যুগ যুগ ধরে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে আসছেন। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঈশ্বর দর্শন দিয়েছেন — এমনটা শোনা যায়। আপনি হয়তো কলকাতায় যাননি। কেউ এসে আপনাকে বললো, "কলকাতায় ট্রাম চলে"। আপনি আগেও শুনেছেন সেখানে ট্রাম চলে। তাই, প্রাথমিক ভাবে আপনার মনে আস্থা তৈরী হবে।
এরপর আপনি কোলকাতায় গিয়ে যখন ট্রাম দেখবেন। তখনই সেটাকে বিশ্বাস বলা হবে। বিশ্বাস হলো এমন কিছু যা আপনি দেখেছেন, এবং আপনি ছাড়া অন্যেরাও দেখেছেন, প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছেন। চাইলেই কেউ তাহা দেখতে বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেতে পারেন। যেমন, ঈশ্বর দর্শনের জন্য যে সকল পদক্ষেপ নিতে হবে সেগুলো সম্পূর্ণ করার পরই ঈশ্বর দর্শন দেবেন। তার পরেই ঈশ্বরের বিশ্বাস জন্মাবে। তাই, বিশ্বাস কখনই অন্ধ ভাবে হয় না। বিশ্বাস সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
এরকম অনেক তর্ক বিতর্ক এবং কুতর্ক আছে যা আমরা আমাদের এই ব্লগ সাইটে আলোচনা করে থাকি। আপনার মতামত ও পরামর্শ নিচে কমেন্ট বক্সে লিখে জানান। আমরা যথা সম্ভব জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো।
0 Comments: