ইসলাম: অর্থ, মূল আদর্শ ও হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তুলনা


সকল প্রকার ধর্মই সনাতন, অর্থাৎ চিরন্তন। কেউ উচু বা নিচু নয়। সবাই নিজেরটা ভালো বলে, অন্যেরটা খারাপ। কারণ, সবাই নিজেরটা জানে, অন্যেরটা জানে না। যেহেতু ঈশ্বর এক, তাই ধর্ম একটাই। সেটা হিন্দু, কিংবা ইসলাম, কিংবা শিখ যাই হোক না কেন। মানবতার কথা বললেই ধর্ম। নইলে অধর্ম।

ইসলাম কী?

আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে ইসলাম নামক একটি মাযহব উদ্ভব হয়, কিন্তু এর বিশ্বাসীরা বলেন সৃষ্টির আদি থেকেই ইসলাম কায়েম ছিলো। 

তা সে যাই হোক, এটি এক সময়, একটি নির্দিষ্ট জাতির কাছে প্রকট পেয়েছে। পরবর্তীতে এটি ধর্মীয় ব্যবস্থায় পরিণত হয়।

৭ম শতকে আরব উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলাম এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। 

ইসলামের অনুসারীরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করে এবং মনে করে, এটি আল্লাহর প্রেরিত চূড়ান্ত জীবনব্যবস্থা। 

ইসলামের অর্থ

"ইসলাম" শব্দটি আরবি "সালাম" থেকে এসেছে, যার অর্থ "শান্তি" এবং "আত্মসমর্পণ"। অর্থাৎ, ইসলামের মূল আদর্শ হলো আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করা এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা।

ইসলামের মূল আদর্শ

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা মূল আদর্শ রয়েছে—

১. শাহাদাহ (কালেমা) – একজন মুসলিমকে বিশ্বাস করতে হবে যে, "আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকারের উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ হলেন তাঁর রাসুল।"
২. সালাত (নামাজ) – প্রতিদিন পাঁচবার নির্দিষ্ট নিয়মে আল্লাহর উপাসনা করতে হয়।
৩. সাওম (রোজা) – রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস রাখতে হয়।
৪. যাকাত – নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, তার একটি অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়।
৫. হজ – জীবনে অন্তত একবার সামর্থ্যবানদের জন্য মক্কায় গিয়ে হজ পালন করা ফরজ।

এছাড়া, ইসলামে ন্যায়বিচার, দানশীলতা, মানবতার কল্যাণ এবং আত্মসংযমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের তুলনা

সৃষ্টিকর্তার ধারণা

ইসলামে একেশ্বরবাদ প্রচলিত, যেখানে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ বা কিছু উপাস্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মে সমগ্র জগতে ব্রহ্মের বিস্তার রয়েছে, সেই এক ব্রহ্মই বিভিন্ন দেব-দেবী রূপে উপাসিত হন।

ধর্মগ্রন্থ

ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো কুরআন, যা ইসলামের সর্বোচ্চ বিধান। হাদিস হলো নবীর কথা ও তাঁর কাজের সংকলন, যা ধর্মীয় ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত হয়। হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ ও গীতা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও অগণিত শাস্ত্র এবং ধর্ম পুস্তক আছে। 

উপাসনা পদ্ধতি

ইসলামে নামাজ, দোয়া, ও জিকির প্রধান উপাসনা পদ্ধতি। হিন্দু ধর্মে পূজা, যজ্ঞ, ধ্যান, জপ ও কীর্তন ইত্যাদি প্রচলিত।

মুক্তি বা পরকাল বিশ্বাস

ইসলামে বিশ্বাস করা হয়, মানুষ মৃত্যুর পর কেয়ামতের দিনে পুনরুত্থানের ধারণা আছে  কেয়ামতের দিনে মৃতরা কবর থেকে জীবিত হবে এবং তার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও পূর্ণ সমর্পণের হিসেব অনুযায়ী জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারিত হবে। হিন্দু ধর্মে পুনর্জন্মের ধারণা রয়েছে, যেখানে কর্মফল অনুযায়ী পরবর্তী জন্ম নির্ধারিত হয়। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আস্তিক নাস্তিক ভেদ নেই। কারণ চূড়ান্ত মুক্তি হলো মোক্ষ, যেখানে আত্মা ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত হয়, আর পুনর্জন্ম হয় না। 

সামাজিক কাঠামো ও বিভাজন

ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম উভয় ক্ষেত্রেই সামাজিক স্তরবিন্যাস দেখা যায়, যা মূলত ধর্মের শিক্ষার পরিবর্তে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার ফল।

ইসলামে তাত্ত্বিকভাবে সব মুসলমান সমান, তবে বাস্তবে আরব মুসলিম ও ধর্মান্তরিত মুসলিমদের মধ্যে সামাজিক পার্থক্য দেখা যায়। বিশেষ করে, আরব অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে বংশগত পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের অনেক সময় নিম্নস্থ মনে করা হয়। যদিও ইসলামের মূল শিক্ষা অনুযায়ী এই পার্থক্যের কোনো ভিত্তি নেই, সামাজিকভাবে এটি প্রচলিত রয়েছে।

হিন্দু সমাজেও জাতিভেদ ব্যবস্থা প্রচলিত, যা মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য গঠিত ছিলো। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোর বিভিন্ন ব্যাখ্যায় জাতিভেদ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। অনেক আধুনিক হিন্দু পণ্ডিত মনে করেন, জাতিভেদ ছিল মূলত কর্মভিত্তিক একটি ব্যবস্থা, যা পরবর্তীতে কঠোর সামাজিক বিভাজনে পরিণত হয়।

উপসংহার

ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম উভয়ই মানুষের নৈতিকতা, আত্মসংযম, এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়। যদিও ইসলামে একেশ্বরবাদ ও নির্দিষ্ট উপাসনা পদ্ধতি রয়েছে, তবু ধর্মীয় বিশ্বাস ও উপাসনার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতা দেখা যায়। মানবতার কল্যাণ এবং আত্মিক উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।

সামাজিক বিভাজন কোনো ধর্মের মূল শিক্ষা নয়, বরং এটি মানুষের তৈরি একটি কাঠামো, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

Advertisement